অনিন্দ্য আরিফ দিব্য : উৎসবমুখর পরিবেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে উদযাপিত হয়েছে বাশিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। ২২ জুলাই সকাল ৯টায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে উৎসব-আয়োজনের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি কলমা ইউনিয়ন পরিষদের বারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব শেখ। পরের কর্মসূচি হিসেবে ব্যানারে রঙিন; বেলুনে সুসজ্জিত ৩০টি গাড়িতে চড়ে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবকদের আনন্দ র্যালি কলমা ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। ৫০ বছরের লগো সম্বলিত শান্তির সাদারঙের পরা টি-শার্ট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী-সুধীজনের সম্পৃক্ততা আনন্দের বর্ণিলতা আরো বাড়িয়েছে। এই মিছিলের সম্মুখভাগে ব্যান্ড-বাদ্য দলের দেশের গানের সুললিত মুর্ছনা মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। নেচে-গেয়ে-মিছিলে প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে বেলা সাড়ে ১১টায়।
বেলা বারোটায় শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে প্রথমেই প্রধান অতিথিকে ফুলেল শুভেচ্ছা প্রদান করেন ৫০ বছর উদযাপন কমিটির সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম এবং সদস্য সচিব শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিপন বনিকসহ অন্যন্যা শিক্ষকগণ মঞ্চে-আসীন অতিথীদের ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নেন। ভিন্নমাত্রার অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শারফুল আরিফ বিপু সঙ্কেত দিতেই একযোগে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে থাকা রঙ-বেরঙের বেলুন ফাটিয়ে উৎসবাঞ্চলকে মুখরিত করে তোলে। পরিচয় পর্বের পর সুধীজন সমাবেশ আয়োজনে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কলমা ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ম্যানকে স্মারক ক্রেস্ট তুলে দিয়েছেন উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ। সুধীজন সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্টসমাজ সেবক এম এ মালেক, দাতা প্রয়াত আরফান উদ্দিন আহমেদের জ্যেষ্ঠ সন্তান মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি শরিফুল আরিফ সোহেল, ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মো. আব্দুল আাজিজ মিঞা ও শহীদুল ইসলাম সুমন, ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সদস্য মো. সিদ্দিকুর রহমান দোকানদার, মো. আব্দুল বারী তালুকদার, মো. আইয়ুব আলী হালদার, শরীফ হাওলাদার, মো. আজিজ হালওলাদার, মো. মজিবর মড়ল, মো. রশিদ পাঠান, মো. নজির দোকানদার, স্বপন দোকানদার, মমিন উদ্দিন দোকানদার (হিরন), মো. দেলোয়ার হোসেন শেখ, মো. ফারুক হাওলাদার, রুহুল আমীন, তোপাজ্জল বেপারী, আবুল কাসেম (টুলু), রমজান দেওয়ান, মাহাবুব মুন্সি প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কলমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব শেখ বলেন, আজকের শিশুরা আগামী দিনের বাংলাদেশ। তাই আমাদের শিশুদের যথাযথভাবে গড়ে তুলতে হবে। কোমলমতি বাচ্চাদের সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। তাদের গায়ে হাত তোলা যাবে না। তাদের পড়ার জন্য সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমি এই স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আন্তরিকভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। আগামীতেও আমি আপনাদের পাশে থাকব।
প্রধান অতিথি গত নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, আমি এই গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতি সবসময়ই দুর্বল। আপনারা জানেন বাশিরা গ্রামের চলাচলের ব্যবস্থা খুবই জরাজীর্ণ ছিল। গত ৫০ বছরের এই অঞ্চলের যদি সেভাবে কোনো উন্নয়ন হয়ে থাকে আমি চেয়াম্যান থাকাকালে হয়েছে। আমি আপনাদের এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেছি। কিন্তু আপনার আমার প্রতি গত নির্বাচনে সুবিচার করেন নাই। আমার প্রতি জুলুম করেছেন। আমার কষ্টটা সেখানেই। আপনারা কেউ কেউ উড়ে আসা অতিথি পাখিকে সমর্থন করেছেন। তবে আমার মধ্যে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নাই। নির্বাচনের পর আমি সব ভুলে গেছি। প্রধান অতিথি আরো বলেন, এই স্কুলের একটি খেলার মাঠ নেই। যা শিশুদের জন্য খুবই দরকার। আপনারা খুঁজে বের করুন আশে-পাশে কোনো সরকারি খাস জমি আছে কীনা। যদি কোথায় কোনো সরকারি জায়গা থাকে আমাকে শুধু জানাবেন, আমি যেকোনোভাবে তা এই বিদ্যালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ করার ব্যবস্থা করব। এই জন্য যদি টাকা-পয়াসা খরচও করতে হয়; আমি তা করব।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং বিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনের রূপকার শারফুল আরিফ বিপু এমন জমজমাট আয়োজন সফল করার জন্য যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি অকৃপণ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমরা শুরুতে স্বল্প আয়োজনে এই অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে বিদ্যালয়ে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই এগিয়ে আসে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে উদযাপন কমিটির সভাপতি এবং সদস্য সচিব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ম্যানেজিং কমিটির সতীর্থরাও এগিয়ে আসেন। প্রধান শিক্ষকসহ সব শিক্ষকই আন্তরিকভাবে ভূমিকার পালন করেন। পাশাপাশি এই বাশিরা গ্রামের বিশিষ্টজন এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানান। ফলে আমাদের পক্ষে এই বিপুল মহাযজ্ঞ সম্পাদন করতে পেরেছি।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আরো বলেন, আমার বাবা আরফান উদ্দিন আহমেদ এই স্কুলের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠালগ্নে যুক্ত ছিলেন আরো দুজন--প্রয়াত শিকীম আলী হাওলাদার এবং আব্দুল হাই তালকদার। আমি তাদের স্মরণ করতে চাই। আমি স্মরণ করতে চাই শ্রদ্ধাভাজন প্রধান শিক্ষক আব্দুর হাফিজ স্যারকে; তিনি আমৃত্যু এই স্কুলের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে এই মহাযজ্ঞের সঙ্গে আলম, ফয়সাল, হিরন মেম্বার, স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিপনসহ অনেকে যুক্ত থাকায় আমাদের পক্ষে আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিমাংশু বনিক বলেন, ৫০ বছর পূর্তির এই দিনে আমি প্রথমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং যোগ্য ম্যানেজিং কমিটির দিক-নির্দেশনায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় প্রতি বছর বৃত্তি পাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণী পরীক্ষায় ১০০% পাশ এবং বিদ্যালয়টি এ গ্রেডে উন্নিত হয়েছে।
উদযাপন কমিটির সভাপতি মো মাহবুবুল আলম, অনুষ্ঠানে আগত অতিথীদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। সদস্য সচিব শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আমরা আগামী দিনেও স্কুলের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকব। স্থায়ী জনপ্রতিনিধি এবং ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি মমিন উদ্দিন দোকানদার (হিরন) আয়োজন সফল সার্থক করার জন্য যারা ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
অনুষ্ঠানের ব্যতিক্রম আয়োজনে এই স্কুল থেকে পাস করা প্রথম ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন বাশিরা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী এবং গ্রামের গুণীজন। স্কুলের প্রতিষ্ঠা থেকে এ পর্যন্ত মেধাভিত্তিক পরীক্ষায় যারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন ছিলেন তারাও। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এই উৎসবকে রাঙিয়ে তুলতে উপস্থিত ছিলেন সকাল থেকেই। ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি সাবেক মেধাবী এবং স্কুল থেকে পাশ করা স্বস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতদের সম্মাননা জানাতে ভুল করেনি।
বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিশেষ অতিথি, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দাতা পরিবারের সদস্যসহ, স্কুলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা অতীতে যুক্ত ছিলেন তাদের সম্মাননা স্মরাক উপহার দেওয়া হয়েছে। বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে এই আয়োজনকে সফল করার জন্য যারা প্রকাশ্যে-নেপথ্যে থেকে যারা ভূমিকা পালন করেছেন। এই স্কুল প্রথম যারা ১৯৭৮ সালে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেছেন তাদেরও সম্মাননা স্মারক দেওয়া হয়েছে। এই বিদ্যালয়ের ১০জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে সাফল্য অর্জনে স্বীকৃতি হিসেবে স্মারক উপহার প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে মো. ওমর হোসেন, নাহিদুল ইসলাম, সুর্বনা আখতার, সুরাইয়া আখতার তাসনিম ও নুশরাত জাহান হাফসা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। আর সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছে মো. শাহজাহান, রতন চন্দ্র মন্ডল, রোমান হোসেন, সাজ্জাত হোসেন ও সাথী আখতার। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষায় যারা মেধার স্বাক্ষর রেখে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে এমন ১০৫ জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আয়োজনটি শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
পথরেখা/আসো