পথরেখা অনলাইন : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাটকীয় পতনের পর বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি বেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। সারা দেশে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার পর শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে সংকট তৈরি করে, বিশেষ করে সেনাবাহিনী বিক্ষোভ দমনে অস্বীকৃতি জানানোয় সংকট চূড়ান্ত সীমা স্পর্শ করে। শেখ হাসিনা এখন ভারতে রয়েছেন এবং নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার এখন (বাংলাদেশের) দায়িত্ব নিয়েছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নতুন সরকার দেশ পরিচালনায় কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বহির্বিশ্ব।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো হলো অভ্যন্তরীণ। একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের পর বাংলাদেশ নানা দিকে যেতে পারে। সেটা গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠতে পারে। হাসিনার শাসনামলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদী’ শাসন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ওই সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, তবে তাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকতে এবং বিরোধীদের নির্মূল করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। ওই শাসনব্যবস্থার আকস্মিক অবসানের পর বাংলাদেশের সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, সংবিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো সংস্কার করার।
তবে ভালো খবর হচ্ছে, বিপ্লব পরবর্তী অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটাই স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও এবং সব খাতে গুরুতর সংস্কার প্রয়োজন হলেও এখনো একটি অন্তঃসারশূন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো টিকে আছে। বড় ধরনের আঞ্চলিক বা নৃতাত্ত্বিক বিভাজন কম থাকায় তুলনামূলক রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক মেরুকরণের আশঙ্কা কম। (যদিও ক্ষুদ্র নৃ‑গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় সহিংসতার উদ্বেগজনক ঘটনা রয়েছে।) তবে এ ক্ষেত্রে শ্রমিক অসন্তোষজনিত আন্দোলন নিয়মিত ঘটনা হলেও তা রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি নয়।
তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে এখন নতুন রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলার মতো শক্ত উপাদান রয়েছে। একই সঙ্গে গুরুতর কিছু বিপদও আছে। এই সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, রাষ্ট্রকে কার্যকর করে তোলা এবং ভেঙে পড়া আইন‑শৃঙ্খলা (ড. ইউনূস যেটি স্বীকার করেছেন) পুনরুদ্ধার করা। প্রতিবাদী জনতার সহিংসতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দেশে হিন্দু-বিরোধী মনোভাব ও ব্লাসফেমি-বিরোধী মনোভাব একই সঙ্গে শক্তিশালী হয়েছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ইসলাম ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সম্পর্ককে মোকাবিলা করবে, সেটি খুঁজে বের করা।
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কার কেমন হবে, কীভাবে হবে, নির্বাচন কখন হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে ইত্যাদি। ইতিহাস বলছে, এ ধরনের পরিবর্তনের চেষ্টা দুটি উপায়ে নস্যাৎ হতে পারে। বেসামরিক নেতাদের স্বৈরাচারী উপায়ে ক্ষমতা দখল, আন্তঃদলীয় অচলাবস্থা, অভিজাতদের ক্ষমতার লড়াই এবং সর্বোপরি পাল্টা-অভ্যুত্থান একটি বিপ্লবোত্তর সরকারকে থামিয়ে দিতে পারে। এমনকি এটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় কিংবা রাষ্ট্র ভাঙনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, রাষ্ট্রের পা থেকে মাথা পর্যন্ত অসন্তোষ। এই অসন্তোষ গণবিক্ষোভে কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতায় রূপ নিয়ে বিপ্লবোত্তার সরকারকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাস্তার বিক্ষোভ থামাতে সরকারকে আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
এই সব বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীদারত্বের ভিত্তিতে স্বচ্ছ লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কীভাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই সিদ্ধান্তও নিতে হবে। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ছিল শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি অসন্তোষের মূল উৎস। ফলে হাসিনাবিরোধী আন্দোলনকারীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন বৈধতা দিলেও, এই সরকারকে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে হলে অবশ্যই অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে হবে এবং রাজনৈতিক অগ্রগতি দেখাতে হবে।
রাজনৈতিক অবস্থা যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার সমালোচনার মুখে পড়বে। কারণ এর সঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তন, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বণ্টন ইত্যাদি জড়িত। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), সেনাবাহিনী ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের সময়সীমা প্রকাশ করেছে। এই বিষয়টি দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একইভাবে পরবর্তী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের অধিকার কেড়ে নেয়া হয় এবং শাস্তি দেওয়া হয়, তবে তাতে বিতর্ক ও মতবিরোধ তৈরি হতে পারে। ফলে একটি নতুন ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের উপায়গুলো কীভাবে আটকে যেতে পারে, সেদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মনোযোগী হতে হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ একটি জটিল বৈদেশিক নীতির মধ্যে বাঁধা পড়ে আছে। হাসিনা সরকারের পতনের ফলে ভারত স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হয়েছে। ভারতের অনেকেই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সহিংসতা ও ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ উসকে দিতে পারে বলে অভিযোগ করছেন ভারতীয়রা। অন্যদিকে অনেক বাংলাদেশি মনে করেন, হাসিনার অপশাসন টিকিয়ে রেখেছিল ভারত। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ইত্যাদি নিয়ে ভারতের বক্তৃতা শোনার মতো পরিস্থিতিতে নেই বাংলাদেশিরা।
দেরিতে হলেও ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির ভুল পদক্ষেপগুলো উপলব্ধি ও শোধরাতে পেরেছে, যা নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কাজে এসেছে। তবে শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক (পাশাপাশি তাঁকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া) থাকায় বাংলাদেশিদের কাছে ভারতের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠা কঠিন। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। আবার আকার ও নৈকট্যের কারণে চীন ও পশ্চিমাদের সঙ্গেও বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকার ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার আশা করছে। তবে এ ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হলে হাসিনার শাসনামলে ভারত যত সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশের কাছ থেকে, তা আর পাবে না।
বাংলাদেশের সামনে আরেকটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মিয়ানমারের ক্রমবর্ধমান গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইনদের মোকাবিলা করা। রাখাইন রাজ্য থেকে শরণার্থী হয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপও মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে।
সবশেষে ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলোতেও নজরে রাখতে হবে বাংলাদেশকে। হাসিনা সরকারকে কীভাবে পরিচালনা করা যায়, তা নিয়ে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে ২০২৪-এর নির্বাচনের পর দুই দেশের মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার পতনকে আমেরিকা তাদের সিদ্ধান্তের প্রমাণ হিসেবে দেখাতে চাইছে। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার শাসনামলে দমন-পীড়ন-নির্যাতন নিয়ে আমেরিকা যে অভিযোগ তুলেছিল, তা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভারতের অনেকেই অবশ্য শেখ হাসিনার পতনের পেছনে ‘আমেরিকার হাত’কে দায়ী করেন।
আমেরিকার কাছে এখন ইউনূস ও তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারকে গণতন্ত্র পুনর্গঠনে সহায়তা করা এবং চীনকে চাপে রাখাই প্রধান অগ্রাধিকার। ভারতের অনেকেই মনে করেন, এই পদ্ধতিটি ইসলামপন্থীদের বিপজ্জনক উত্থান ঘটাবে। এটি এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব কমানোর একটি কূটকৌশল।
বাংলাদেশে চীনের প্রভাব নিয়ে আমেরিকা ও ভারত উভয়েই উদ্বিগ্ন। শেখ হাসিনা বেইজিংয়ের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরির পাশাপাশি ভারতের সঙ্গেও সফল সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর চীন বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। আমেরিকা চায়, বাংলাদেশে সুশাসন, কার্যকর গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও চীনের প্রভাব কমিয়ে আনা। ওয়াশিংটনের জন্য এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে,
ঢাকা আমেরিকার চীন নিয়ন্ত্রণ কৌশলের অংশ হওয়ার জন্য একটু হলেও আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে নেপাল ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনে আমেরিকা ভূমিকা রাখলেও সরাসরি বিকল্প দেখাতে পারে না। বিপরীতে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]
নিবন্ধটি কার্নেগি এনডাওমেন্টে গত ১৫ অক্টোবর, ২০২৪ প্রকাশিত হয়। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম
পথরেখা/এআর