► ড. রাজিয় সুলতানা
আজ ৪ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক ধানুয়া কামালপুর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুর দুর্গের পতন হয়। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বরাবরের মতো এবারও হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হচ্ছে। সারাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ থাকলেও স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, জামালপুর জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। আয়োজনের অংশ হিসেবে ধানুয়া কামালপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিগুলো হচ্ছে— সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের দেবিমূলে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, ক্ষুদ্র নৃ-গৌষ্ঠির শিল্পীদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে মধ্যাহ্ন প্রীতিভোজ।
জাতীয় জীবনে কামালপুরের যুদ্ধ এক অনন্য অসাধারণ স্থান দখল করে রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামপর্বে ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধ শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উৎসাহের প্রতীকই ছিল না। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী একটা বার্তা দিতে সক্ষম হয় যে, তারা এখন কেবলই গেরিলা যুদ্ধ নয়, প্রয়োজনে সম্মুখযুদ্ধেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমানতালে লড়তে প্রস্তুত। ৩১ জুলাই, ২২ অক্টোবর, ১৪ নভেম্বর, ২৪ নভেম্বর এবং ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘হিট অ্যান্ড রান’ হয়েছে মোট ২০ বার। মুক্তিযুদ্ধে কামালপুর অভিযানে সর্বমোট ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচের কোম্পানি কমান্ডার মেজর আইয়ুবসহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন। বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসীকতা পদক পেয়েছেন কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্যই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুবই বিরল।
ভারতের মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ ছুঁই ছুঁই জামালপুর জেলার পাহাড় ঘেঁষা বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর অবস্থিত। পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এখানে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। তাদের মূল টার্গেট ছিল উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উড়িয়ে দিয়ে ওই ঘাঁটি দখল করা। উল্লেখ্য, ধানুয়া কামালপুর ভয়াবহ খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে বারুদে অঞ্চলে পরিণত হয়। পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পর ৪ ডিসেম্বর সকালে সেক্টর কমান্ডার সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদকে (বীরপ্রতীক) পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার আদেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধা বশির জীবন বাজি রেখে সারেন্ডারপত্র নিয়ে ক্যাম্পে যান। এই চিঠির প্রেক্ষিতে হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
ধানুয়া কামালপুর রণাঙ্গন সম্পর্কে সৃজনশীল ও জনবান্ধব ব্যক্তিত্ব সরকারের অতিরিক্ত সচিব গাজী মো. সাইফুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘জাতীয়ভাবে ধানুয়া কামালপুর মুক্তদিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু এখনো নতুন প্রজন্ম কামালপুর রণাঙ্গন সম্পর্কে সবিস্তারে জানে না। তাদেরকে জানাতে হবে, এখানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বারবার সরাসরি যুদ্ধ হয়েছে। খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে শহিদের সংখ্যা প্রায় ২০০ জন। বিশেষ করে ৩১ জুলাই সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম শাহাদাত বরণ করেন। মির্ধাপাড়া মোড়ে সম্মুখ যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে মেজর আবু তাহের পা হারিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আগে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুরের শহিদদের স্মরণে এই দিনে নানা আয়োজন করত। এক কথায় কামালপুর মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হয়ে রয়েছে।’
কামালপুর রণাঙ্গন সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক হারুন হাবীব বলেছেন— ‘আমি সরাসরি যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত রাঙিয়ে শত্রু মুক্ত করেছে ধানুয়া কামালপুর। যুদ্ধে অনেকেই শহিদ হয়েছেন; গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী নির্লিপ্তভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে বিভিন্ন স্থানে গণকবর দিয়েছে। তবে কারণে আজ পর্যন্ত বকশীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠেনি। গণকবরগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণও করা হয়নি।’ তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ধানুয়া কামালপুরের মির্ধাপাড়া মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের পাশাপাশি গণকবরগুলো রক্ষার্থে সরকারী উদ্যোগ নেওয়ার দাবী জানান।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমন্বয় পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সদস্য সচিব মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন— ‘মুক্তিযুদ্ধকালে ধানুয়া কামালপুর ছিলো ১১ নং সেক্টরের আওতায়। যুদ্ধে এ সেক্টরের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের শুরুতেই হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে গড়ে তোলে শক্তিশালী ঘাঁটি। সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল আক্রমণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এ ঘাঁটির হানাদাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ ঘাঁটি পাক বাহিনী মুক্ত করার মধ্য দিয়ে শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও দেশের উত্তর মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোসহ ঢাকা বিজয়ের পথ সহজ হয়ে যায়। ৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর অফিসার আহসান মালিকের নেতৃত্বে ১৬২ জন সেনার একটি দল যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসর্মপণ করে।’
তিনি আরো বলেছেন— ‘বকশীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমি রয়েছে। কিন্তু অযত্ন-অবহেলায় তা হারিয়ে যেতে বসেছে। গণকবরগুলো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নের ধানুয়া গ্রামের ৮ নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনায় গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ধানুয়া কামালপুর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই স্মৃতি সৌধটি ১১ নম্বর সেক্টরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক। মেজর আবু তাহেরের স্মৃতি রক্ষার্থে ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে তাহের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বকশীগঞ্জ এনএম উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের গণকবরটি সংরক্ষণ করা হলেও বকশীগঞ্জ সরকারি উলফাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাক সেনাদের টর্চার শেলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষের গণকবর সংরক্ষণ করা হয়নি। বাট্টাজোড় পশ্চিম দত্তের চর গ্রামের গণকবরটি এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি।’
জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান নানা প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিডিআরের নিজস্ব অর্থায়নে ধানুয়া কামালপুরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ মুক্তিযুদ্ধের এই স্থাপনা দেখতে আসেন।’ তিনি এক প্রশ্নে জবাবে বলেন— ‘এই অঞ্চলের গণকবর ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে আরো কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।’
বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অহনা জিন্নাত বলেছেন, ‘ডিসেম্বর মাস এলেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মিলন মেলায় পরিণত হয় ধানুয়া কামালপুর। কামালপুর রণাঙ্গন সন্দেহাতীতভাবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কালের সাক্ষী। কামালপুরের যুদ্ধ যেমন ঐতিহাসিক; তেমনি পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণও ইতিহাস সমৃদ্ধ।’
কামালপুর রণাঙ্গনের দুঃসাহসিক নায়ক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ [বীর প্রতীক] জানিয়েছেন স্মৃতি বিজড়িত সেই দিনের আত্মসমর্পণের গল্প। তিনি জানিয়েছেন ‘৩ ডিসেম্বর;সারাদেশে ব্যাপক যুদ্ধ চলছে। এখানেও তাই। কিন্তু ওইদিন রাতে মহেন্দ্রগঞ্জে ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টারে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো পরদিন পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়া হবে। নয়তো বিমান হামলা ও স্থল হামলা চালানো হবে। আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে জীবন বাজি রেখে আমি পাকিস্তানিদের ব্যারাকে যাই। আমার দেরি দেখে সাড়ে তিনটার দিকে সঞ্জুকে পাঠানো হলো। আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ায় বোমা হামলা করা হলো পাকিস্তানি ক্যাম্পে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হলো। আমরা ক্যাম্পে ফিরে আসলাম। আত্মসমর্পণের চিঠি পৌঁছে দিতেই সবাই উৎসবে মেতে উঠল। বলা যায় এই অঞ্চল থেকে দেশ বিজয়ের উৎসব শুরু হয়ে গেল।’
সাদামাটাভাবে কামালপুর মুক্ত দিবস পালনের সূচনার বন্ধুর পথ ছাপিয়ে এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। বাড়ছে এর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও এই দিবসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। তারাও নিজেদের নানাভাবে সম্পৃক্ত করছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিজয় এসেছিল ধানুয়া কামালপুর রণাঙ্গন থেকেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও কামালপুর মুক্ত দিবসে সম্পর্কে অবহিত। স্থানীয় প্রশাসনও আন্তরিকভাবে দিবস উদযাপন করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম বিজয়সারণী হয়ে রয়েছে কামালপুর রণাঙ্গন।
পথরেখা/আসো