ঈপ্সিতা হালদার : এক-একটা সময় আসে যখন একটা বিকল্প পৃথিবীর, রাষ্ট্রের, ভবিষ্যতের কল্পনা করে বসে মানুষ। বিকল্পের সেই কল্পনা দিবাস্বপ্ন বা ফ্যান্টাসিবিলাস নয়, বরং আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সেখানে মিলে থাকে সামগ্রিক সমাজ বদলের আশা। একেই বলে ইউটোপিয়া। যেমন গান্ধীর রামরাজ্য, যেখানে সত্য, অহিংসা আর ধর্মের নৈতিক স্ফুরণ ঘটবে। যেমন আম্বেডকরের প্রবুদ্ধ ভারত, যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের বদলে নব রাষ্ট্রের কেন্দ্রে থাকবে মুক্তি ও সাম্যের বাণী। যেমন, রবীন্দ্রনাথের কাছে উঠোনের ঘেরাটোপ থেকে জ্ঞান ও সৃজনীশক্তির মুক্তি, ভারত থেকে বিশ্ব-ভারতের বিপুল সম্ভাবনার দিকে ব্যক্তির যাত্রা। তেমনই, ১৯০৫ সালে মাদ্রাজের পত্রিকা দি ইন্ডিয়ান লেডিজ় ম্যাগাজ়িন-এ বেগম রোকেয়ার ইংরেজিতে লেখা ‘সুলতানা’স ড্রিম’ নামে কল্পবিজ্ঞানমূলক গল্পটিও ইউটোপিয়ার কথা বলে। এখানে লেডিল্যান্ডে মেয়েরা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে রাজ্যচালনা করেন। তাঁদের দক্ষ বিজ্ঞান গবেষণায় পুরুষের আগ্রাসী গোলাবারুদের সামরিক শক্তি পর্যুদস্ত হয়ে যায়। লেডিল্যান্ডের দু’হাজার মহিলা বৈজ্ঞানিক সৌরশক্তিকে এমন কৌশলে কাজে লাগান, যাতে পুরুষের সামরিক বাহিনী সেই অসহ্য তাপ আর আলোর তীব্র ছটায় ঝলসে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আক্রমণাত্মক সামরিক পৌরুষের বিরুদ্ধে লেডিল্যান্ডের বৈজ্ঞানিকরা বিশ শতাব্দীর প্রতিষ্ঠা করেন এক যুদ্ধবিরোধী ইকলজি সংবেদী বয়ান।
আর লেডিল্যান্ডের পুরুষরা তা হলে কোথায় থাকে? তারা থাকে অন্দরে। ঘর গেরস্তালিই তাদের জায়গা। সদর পুরুষের আর নারীর জায়গা অন্দরের অটুট ঘেরাটোপে, জাতীয়তাবাদের প্রথম পর্যায়ের এই যে ঘরে-বাইরের লিঙ্গ সমীকরণ, তাকে উল্টো ঘুরিয়ে দেন রোকেয়া। কিন্তু তিনি আদপেই জেনানার বদলে মরদানার ফাটকে পুরুষকে আটকে দেওয়ার দাওয়াই বাতলান না। ক্ষমতার পাশা উল্টে প্রতিশোধের গল্প নয় এটা। পুরুষকে নারীর ভূমিকায় গেরস্তালিতে আর নারীকে পুরুষের মতো সমাজ সামলাতে দেখলে যে অদ্ভুতুড়ে লাগে, তার মধ্যে দিয়েই রোকেয়া দেখান নারীর অবরোধও সে রকমই অন্যায্য, প্রকৃতিবিরুদ্ধ। লেডিল্যান্ডের উলটপুরাণ ‘মেয়েরা সব লড়ুই করেন মদ্দ করেন চড়ুইভাতি’ নয়। এর আগেই যেমন রোকেয়া বলেছিলেন ‘অর্ধাঙ্গী’ (১৯০৪) প্রবন্ধে, যে নারী পুরুষ সমাজে ও পরিবারে সম্পূরক, তারা একই শকটের দু’টি চাকা। যেমন পদ্মরাগ (১৯২৪) উপন্যাসের মূল কথাটিই হল, মহিলারা কোনও ভাবেই ন্যূন নয়। নারীর অবরোধ নিয়ে রোকেয়া কথা বলে গেছেন আজীবন। সেই স্বর আপসহীন ও ক্ষুরধার। ১৯০৪ সালে নবনূর পত্রিকায় ‘আমাদের অবনতি’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলইয়া প্রকাশ করিয়াছে। ...যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেখানেই নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল, সেখানে নারীরা প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এ স্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।”
বেগম রোকেয়ার জন্মদিনটি, ৯ ডিসেম্বর, বাংলাদেশে পালিত হয় রোকেয়া দিবস হিসাবে। রাষ্ট্র বেগম রোকেয়া পদক দেয় অগ্রণী মহিলাদের। এই বঙ্গে ও দেশে বিদেশে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়ে অজস্র গবেষণা হয়ে চললেও, সাধারণ ভাবে আমরা না মন দিয়ে পড়ে উঠি রোকেয়া রচিত সাহিত্যকে, না জানতে চেষ্টা করি সেই সময়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীর নবতর আদল পেতে রোকেয়ার সামাজিক অবদানকে।
১৮৮০ সালে জন্ম রোকেয়ার। সে একটা আশ্চর্য দশক। সবে কলকাতা ঘুরে গেছেন প্যান-ইসলামীয় ধারণার প্রবক্তা জামালুদ্দিন অল-আফগানি। বাঙালি মুসলমান সমাজে একটা প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেছে, যারা ব্রাহ্ম ও হিন্দু লেখক বুদ্ধিজীবী ধর্মসংস্কারকদের সঙ্গে সমান তালে বাংলার জনপরিসরে জায়গা করে নিচ্ছেন। স্যর সৈয়দ আহমদ খান ও সৈয়দ আমীর আলির লেখা চর্চিত হতে শুরু করছে। ইসলামের ‘প্রামাণ্য’ ইতিহাস, হজরত মহম্মদের ঐতিহাসিক জীবনী লেখা যেমন, তেমন এই দশকেই ছাপা হয়েছে কারবালা যুদ্ধের উপর রচিত মীর মোশাররফ হোসেনের গদ্য আখ্যান বিষাদসিন্ধু। নিজেদের আত্মপরিচয়ের নির্মিতিতে নিজের বাঙালিত্বকে এবং নিজের মুসলমানত্বকে দাখিল করাই বাঙালি মুসলমানের মূল অভিপ্রায় হিসাবে দেখা দিয়েছে। সেই বাঙালিত্বের অধিকার পেতে তৎসম বাংলাকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বলে দাবি করা এই নতুন প্রজন্মের সঙ্গে বিরোধ ছিল সমাজের সাবেক শরিফশ্রেণির, যারা উর্দুকেই বাঙালি মুসলমানের ভাষা হিসাবে চাইছিলেন।
রোকেয়া আসছেন বাংলার সেই উর্দুভাষী সমাজ থেকে যেখানে ‘ভদ্র মুসলমান পরিবারের কন্যাগণ’কে কোরান পড়ার জন্য বাড়িতে মৌলবিসাহেব এসে আরবি তালিম দিলেও, বাংলাভাষা শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। এই সাবেক উর্দুভাষী পরিমণ্ডলে যখন দেখি বালিকা রোকেয়াকে তাঁর দাদারা বাংলা ও ইংরেজি শেখাচ্ছেন, আমাদের দুই প্রজন্মের মাঝে রোকেয়াকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। সেই যে যেমন রাসসুন্দরী দেবীর স্বামী মেয়েদের জন্য শিক্ষা রদ এই ধারণায় বিশ্বাসী হলেও, ছেলে এসে বলেছিল না, মা, তুমি আমাদের চিঠি লেখো না কেন? ‘সুলতানা’স ড্রিম’-এর প্রথম পাঠকই তো রোকেয়ার স্বামী, সাখাওয়াত হোসেন। উর্দুভাষী পরিবারে বসে মনন চর্চার জন্য রোকেয়া বেছে নিচ্ছেন বাংলা, ইংরেজিও। এ-ই তা হলে বাঙালি মুসলমান সমাজে ভদ্রমহিলাদের আবির্ভাবের কাল!
রোকেয়া জানতেন মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার জগতে নিয়ে এলে তবে ঘুণধরা সমাজ বদল হবে। হিন্দু ও ব্রাহ্ম সভা ও মিশনের মতো সেই মুসলমান সমাজে সমাজসংস্কারের জন্য আঞ্জমান ছিল বটে, কিন্তু তা ছিল পুরুষের ক্ষেত্র। ৩৫ জন সমমনস্কাকে নিয়ে রোকেয়া খুলেছিলেন আঞ্জমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম, সাধারণ মুসলমান পরিবারের মেয়েদের জীবনপ্রণালী, গৃহস্থালি সামলানোর ট্রেনিং ও বনিয়াদি শিক্ষা দিতে। বেগম রোকেয়া নিজের পরলোকগত স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ব্রাহ্ম ও হিন্দু মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চল শুরু হলে যেমন সেকেলে ব্রাহ্মণ্য সমাজে ছিছিক্কারের বন্যা বইছিল, এখানেও তার ব্যত্যয় ছিল না। ব্রাহ্মমহিলাদের সঙ্গে তুলনা করে ব্যঙ্গ চলত, মীর মোশররফ হোসেন মুসলমান মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চল দেখে গাজী মিয়াঁর বস্তানী-তে রগড় করে এঁদের বলেছিলেন ‘এনলাইটেনড বিদ্যাবতী, মডেল ভগিনী।’ ‘বেগম ঠাকরুন’-দের মধ্যে কোন্দল আর ‘সুপথহারা বেওয়া’দের কিস্সা লিখতে তদানীন্তন বাঙালি মুসলমান সমাজে জোশের কমতি ছিল না। উল্টো দিকে, মহিলাদের পালনীয় শরিয়তি বিধি নিয়ে নেক বিবির কেচ্ছা (কিস্সা) ধরনের সহজ শিক্ষা পুস্তক ছেপে বেরোলেই একের পর এক সংস্করণ শেষ হয়ে যেত, চাহিদা ছিল এমন উচ্চে। এই সব চটি কিতাবে জরুর পর্দা অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হয় মুমিনের উপর। পর্দা ঠিক মতো না হলে মুসলমান পুরুষের জুটবে জাহান্নমের আগুন গরম তেলে জ্যান্ত ভাজা ভাজা হওয়ার শাস্তি। এরই পাশাপাশি যখন রোকেয়া বেবি শো-তে শিশু নিয়ে উপস্থিত মুসলমান মহিলাদের সম্ভাষণ করেন ‘উপস্থিত ভদ্রমহিলাগণ’ বলে, সেই সম্ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ‘হে আমার আমেরিকাবাসী ভাই ও ভগিনীগণ’-এর থেকে কিছুমাত্র ন্যূন নয়। সেখানে প্রসূতির স্বাস্থ্য, আঁতুড়ের পরিচ্ছন্নতা, শিশুর পরিচর্যা এগুলি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়। আর এ সব দেখে অন্যদের মন্তব্য হয়, ‘ধ্বংসের পথে বাঙালি মুসলমান’।
মনে রাখতে হবে, সৈয়দ আমীর আলি যখন ব্রিটিশের কাছে আরও মাদ্রাসা খোলার দাবি জানাচ্ছিলেন, তা ছিল বঙ্গের ফারসি-উর্দুভাষী মুসলমানের জন্য, বাংলাভাষীদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। বাংলাভাষী মুসলমানকে আলাদা করে দাবিদাওয়া জানাতে হয়েছিল। অন্য দিকে, তাঁদের ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদী আবেগে হিল্লোলিত বাঙালি সমাজে নিজেদের বাঙালি বলে প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ দায়। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল খোলার কয়েক বছরের মধ্যেই উর্দুর সঙ্গে যখন বাংলা পড়ানো চালু হয়, বোঝা যায় আসলে নিজে উর্দুভাষী পরিমণ্ডল থেকে এলেও নিজে ওতপ্রোত ছিলেন বাঙালি মুসলমান হিসাবে।
আলো কোথায় ছিল এই কিশোরীদের কাছে? নবাবি পরিবার থেকে আসা লেখিকা নুরুন্নেসা খাতুন বলেছিলেন, প্রকৃতি বলতে তাঁরা জানতেন কেবল রাতের তারা-জ্বলা আকাশ, তা বাদে কিছুই দেখার অধিকার ছিল না। এই নিয়ে রোকেয়া লিখে গেছেন আজীবন। ক্রমে বাঙালি মুসলমান ভদ্রমহিলারা পছন্দ করছেন ব্রাহ্মিকা শাড়ি, জ্যাকেট, শেমিজ়, পেটিকোট, জুতো। বোরখা ছিল রোকেয়ার কাছে নারীর অবদমনের একটি হাতিয়ার। অবদমন নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেই চলেছিলেন নানা পত্রিকায়, ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’, ‘অর্ধাঙ্গী’, ‘বোরকা’, ‘গৃহ’ ইত্যাদি প্রবন্ধে। প্রশ্ন তুলছিলেন, গার্হস্থ নারীর অলঙ্কার, না কি ‘ব্যাজ অব স্লেভারি’? অবরোধবাসিনী বইতে দেখান, পিতৃতান্ত্রিক এই অবদমন মহিলারা মনের মধ্যে কেমন গেঁথে নেয়। মামানী সাহেবা রেললাইনে আটকে যাওয়া বোরখা টেনে ছাড়াতে না পেরে রেলের নীচে ‘পিষিয়া ছিন্ন ভিন্ন’ হয়ে মৃত্যুকেই বেছে নেয়।
রোকেয়ার বোরখা সমালোচনাকে কিন্তু ‘পর্দা মানে রক্ষণশীলতা, আর বোরখা ত্যাগে আধুনিক’ এই সহজ সমীকরণে ফেলা চলবে না। রোকেয়ারা সকলেই বাইরে বোরখা পরতেন। ওঁদের কাছে বোরখা অবরোধের শিকল ছিল না। ছিল বাইরে বেরোনোর হাতিয়ার। যেমন উর্দু ভাষার অতি গুরুত্বপূর্ণ লেখক ইসমত চুঘতাই-ও বোরখা পরে বি এ পড়েছিলেন, নাহলে তিনি আলিগড় থেকে লখনউ এসে ভর্তি হতে পারতেন না। রোকেয়া লেখার পর লেখায় বাঙালি মুসলমান নারীর অবদমনের নানা কারণকে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এই জগতে আমরা আজও ‘দাস হইয়া আছি’। যাতে কেউ যদি বোরখা পরেন, তিনি যেন জানেন কেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এ সবই আজও কত প্রাসঙ্গিক।
পথরেখা/আসো # সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা