লেফটানেন্ট কর্নেল মাফুজ ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়ার পারসোনাল সেক্রেটারি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার চট্টগ্রাম যাবার কথাছিল বিএনপির দলের মধ্যে কোন্দলের মীমাংসার জন্য। তবে তিনি অসুস্থ ফিল করায়, পিএস কর্নেল মাহফুজকে ট্যুর বাতিল করতে বলেন। তিনি ডায়রি দেখিয়ে বলেন এখন না গেলে আগামী ৬ মাস এত ঠাসা প্রোগ্রাম যে চট্টগ্রাম যাওয়াই হবে না। জেনারেল জিয়া গেলেন। পিএস মীর জাফরি করলে করার আর কি থাকে?
বান্দরবন থেকে আমাদের ব্যাটেলিয়নের ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে আরও সাতজন গিয়ে ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে এ্যাসোল্ট কোর্স কম্পিটিশনে অংশ নিতে। রফিক চট্টগ্রাম থেকে কল করে বলে, সেনানিবাসের পরিবেশ কেমন থম থমে। যে সব অফিসার চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে থেকে এসেছে তারা বিভিন্ন অজুহাতে সিএমএইচে ভর্তি হচ্ছে। সিও কর্নেল মুহিত ওদের জানাল- ওরা যাতে শহরেই থাকেন। প্রেসিডন্ট জিয়াকে হত্যা করতে শুধু অফিসাররাই অংশ নিয়ে ছিল। একজন প্রেসিডন্ট হত্যার এটাই মনে হয় শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম তারপর মাঠ (এ মাঠে আমরা প্রায়ই সন্ধ্যা আড্ডা দিতাম ) মাঠের পর সার্কিট হাউস। এ স্টেডিয়ামের থেকেই রকেট ল্যাঞ্চার ফায়ার করে যে রুমে প্রেসিডেন্ট ছিল, সে দরজা ভাংগা হয়। রকেট ল্যাঞ্চারে কোন রিকোয়েললেস স্প্রিং নেই যার ফলে প্যারাবলিক পাথ তৈরি করে না। সরাসরি টার্গেটে হিট করে। রাইফেলের নলের ভিতর চোখ দিলে প্যাচানো রেখা দেখা যায়, গুলিটা বের হবার সময় এই প্যাচের কারণে স্পিন করে শরীরে ঢুকার সময় গর্ত হবেই। তবে এই স্পিনের কারণে গুলি বের হবার গর্ত অনেক বড় হয়।
সময় ঠিক করা ছিল রকেট ল্যাঞ্চার ফায়ার করার মিনিট দুয়েক আগে কিলিং পার্টি দোতালার সিড়ির দিকে দৌড় দিবে। প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল মুইনুল হাসান। আমাদের সিনিয়র টাইগার্সেরই সিও ছিলেন। এখান থেকেই তিনি পিজিআর এর সিও হন। ছিলেন ব্লাক বেল্ট ও। তিনি সিড়ির মুখে বাঁধা দিলে তাকে ও তার সাথের সৈন্যদের মেরে এরা দোতালায় পৌছে, রকেট ল্যাঞ্চারের আঘাতে দরজা ভাংগার আওয়াজে প্রেসিডন্ট জিয়া রুম থেকে বের হন। ক্যাপ্টেন মোছলেহ সবার আগে প্রেসিডন্ট জিয়ার কাছে পৌছে যান। মোছলেহ কিলিং মিশনে তারপরও প্রেসিডেন্টকে সামনে দেখে বলে, স্যার আপনি রুমে ঢুকে যান। আমার পিছনের সবাই আপনাকে মারতে আসছে। তবে ওর কথা শেষের আগেই কর্নেল মতিয়ূর পৌছে যান জিয়ার কাছে। আর পুরো স্টেনগানের ম্যাগাজিন জেনারেল জিয়ার বুকে খরচ করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ সার্কিট হাউসের দোতালায় পরে থাকে। পরদিন সকালে ঢাকা থেকে আসা বিএনপি নেতা বদ্দোরদোজাসহ সব নেতারা ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। কেউই তাদের গাড়িতে করে প্রেসিডন্ট জিয়ার লাশটি নিলেন না। ১৯৭১ সনের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আনোয়ার পাকিস্তানি ব্যাঙ্কারের সামনে নিহত হন। আনোয়ার স্যারের লাশ আনতে গিয়ে আরো ১৭ জন সৈন্য নিহত হয়। তারপরও লাশ নিয়ে আসে। এটাই আর্মি স্পিরিট।, এটাই সেই ট্রেনিং যা সহমর্মিতা সৃষ্টি করে। কিলিং মিশনে যারা ছিল সবারই ফাসি হয় শুধু মোছলেহ জেল হয়। এই জন্য যে সে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সরে যাবার জন্য তাগাদা দিয়ে ছিল।
৬৯ ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেড্য়ার মহসিন। রিনার খালাত ভাই। কেন জানি আমার সাথে রিনার সম্পর্ক মানতে পারতেন না। বান্দরবন শহরে আমাদের অফিসার্স মেসটি বেশ উঁচু। নীচে গাড়ি থাকে। সিড়ি দিয়ে ১০/১২ ধাপ উঠতে হয়। গেমস শেষ করে রুমে ফেরত যাব। দেখি ব্রিগেডিয়ার মহসিন সিড়ির মুখে বসা। আমি হাফ প্যান্ট -গেন্জি পরা। আমাকে দেখে বললেন, হোয়াই ইউ আর ইন দিজ ড্রেস? বললাম স্যার ফ্রেস হয়েই ফুল স্লিপ পড়ব। তখন হিলট্রাকসে সেলিব্রিয়াল ম্যালেরিয়া হচ্ছে তাই মশা থেকে সাবধানতা ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তবে সিচিওশন ত বুঝতে হবে। তিনি তিন দিনের নাইট পেট্রলে যাবার নির্দেশ দিলেন। গেলাম। রিনার খালাত ভাই বলে কথা।
যে দিন জিয়া মারা যান, সে দিন সমগ্র চট্টগ্রাম জানে কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলছে। আমাদের এ্যাসোল্ট কোর্স কম্পিটিশনে অংশ নিতে যাওয়ার বান্দরবনে কল করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা বলছে। আমাদের এত গোয়েন্দা সংস্থা তারা টের পায় নাই? অথচ বাংলাদেশকে বাঁচাতে
‘আমরা একটি ফুল কে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি ‘মানুষ বাঁচাতে কেন করি না?
লেখক : সাবেক হকি অধিনায়ক জাতীয় এবং সেনাবাহিনী দল, জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার জয়ী এবং কলামিস্ট
পথরেখা/আসো