ড. আতিউর রহমান, পথরেখা অনলাইন : সামনে বাজেট। এমন এক সময়ে এবারের বাজেটে ঘোষণা করা হচ্ছে যখন বিশ্বজুড়েই দেখা দিয়েছে নানা মাত্রিক সংকট। বাড়তি মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রিক বিশ্ব আর্থিক কঠিন পরিস্থিতি ছাড়াও দেশে দেশে ডলারের দাম বেড়ে যাবার কারণে তাদের মুদ্রার মানে ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটেছে। এর ফলে আমদানি করা যেকোনো যন্ত্র, পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তাই বিনিয়োগের হার কমেছে। প্রবৃদ্ধিও সংকোচিত হচ্ছে। অথচ মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে মুদ্রানীতি ও বাজেট সংকোচন অপরিহার্য। এর প্রভাবেও কাজকর্ম সংকোচিত হচ্ছে। দারিদ্র্য বাড়ছে। এই বাস্তবতা এক দিনে হয়নি। করোনা মহামারি ও ভূ-রাজনীতি ছাড়াও অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সংকটও এ জন্য দায়ী।
নিঃসন্দেহে করোনা মহামারিজনিত সঙ্কট এবং তার পরপরই রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পরিবেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের সামনে সঙ্কট মোকাবিলার জন্য চার-দফা নীতি-প্রস্তাবনা হাজির করেছে
(১) জীবাশ্ম জ্বালানি সরবারহকারিদের অতিরিক্ত মুনাফার ওপর যথাযথ করারোপ করে প্রাপ্ত রাজস্ব দিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে অর্থায়ন;
(২) জ্বালানি চাহিদার লাগাম টেনে ধরা;
(৩) জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা থেকে সরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে বেগবান করা;
(৪) সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তর কার্যক্রমে অর্থায়নকে যতোটা সম্ভব বলশালী করা। বিদ্যমান বিশ্ব বাস্তবতায় কেবল প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার জন্য নয় বরং সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করার জন্যও নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ-সহ অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সামনের দিনগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তিকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি কিংবা উন্নয়ন সহযোগিদের সঙ্গে দেনদরবারের বিষয় হিসেবে বিবেচনায় রাখার সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ-এর ওই প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতিয়েরেস বলেছিলেন, ‘এই প্রস্তাবনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে কতো সময়ের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর কতোটুকু বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পথ-নকশা দাঁড় করিয়ে এগোতে হবে। ’ বাংলাদেশের জন্য আশাব্যঞ্জক বিষয়টি হলো এদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন নীতি-নির্ধারকেরা।
২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৪০ শতাংশ যেন নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসে তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নির্দেশনা রয়েছে। নানা প্রতিকূলতার কারণে এর আগে ২০১৫ সালের মধ্যে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য এবং ২০২০ সাল নাগাদ এই অনুপাত ১০ শতাংশে উন্নিত করার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে পরবর্তীকালে এ খাতের নীতি-নির্ধারকরা বারবার নতুন উদ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন বাড়ানো এবং এক্ষেত্রে যথাযথ নীতি-প্রণোদনা দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে নিজস্ব জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ শেষের দিকে থাকায় এবং জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার জেরে সেচের জন্য ডিজেলের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার উৎসাহিত করা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার উৎসাহিতকরণের নতুন ঢেউ দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই গার্হস্থ্য পর্যায়ে বিশ্বের বৃহত্তম সোৗর বিদ্যুৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক টেকসই অথবা সবুজ অর্থায়ন বিষয়ে নানাবিধ নীতি-নির্দেশনা ও প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে সংবেদনশীল ও সক্রিয় করে তুলেছে।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সময়কালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সবুজ অর্থায়নের পরিমাণ গড়ে বছরে ১৮ শতাংশ করে বৃদ্ধির মাধ্যমেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সবুজ অর্থায়নের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের বিকাশেও বিনিয়োজিত হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে- ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টাকার সবুজ অর্থায়ন করেছে তার ৫ শতাংশের বেশি (প্রায় ৮ বিলিয়ন টাকা) গেছে নবায়নযোগ্য শক্তিতে। দেশের আর্থিক সেবা খাতে যে নীতি-নির্দেশনা বহাল রয়েছে তার বদৌলতে আগামী দিনে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থায়নের এ অনুপাত আরও অনেকখানি বাড়ানো সম্ভব হবে। তবে নবায়নযোগ্য শক্তি উদ্যোক্তাদের এ খাতে নিয়োজিত থাকা নিশ্চিত করতে মুদ্রানীতির ধারাবাহিক উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব নীতি তথা জাতীয় বাজেটেও সম্পূরক নীতি-উদ্যোগ থাকা চাই। অধিকাংশ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও ইনপুটস উৎপাদিত হয়না। ফলে আমদানি করতে হয়। বিগত দুই দশকে সারা বিশ্বেই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। তবুও সাম্প্রতিক কালে বিশেষ করে আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রসারের গতি কমে আসছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ ঐ সব দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ও ইনপুটস আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও করের বোঝা। যেমন: সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশে সোলার সেল ও মডিউল আমদানি থেকে আহরিত শুল্ক ও করের ওপর সরকারগুলো বেশি মাত্রায় নির্ভর করায়- সোলার হোম সিস্টেমের দাম বেড়ে যাচ্ছে। উল্টো দিকে রাজস্ব নীতিতে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের বিকাশে সহায়ক ব্যবস্থা রেখে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও বিরল নয়।
সিঙ্গাপুরে সরকার নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে কোন ভর্তুকি না দিয়ে এ খাতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও ইনপুটস আমাদানির ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে যাচ্ছে। এই নীতি-কৌশলের ওপর ভর করে তারা তাদের সৌরশক্তি উৎপাদন সক্ষমতা ২০১৭ থেকে ২০২০ সময়কালের মধ্যে দ্বিগুনেরও বেশি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এমনি এক বিশ্বপ্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আসন্ন বাজেটের কেন্দ্রে থাকা চাই মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ এবং সবুজ অর্থায়নের সুনির্দিষ্ট কৌশল। বাজেটের সবুজায়ন করতে চাইলে প্রথাসিদ্ধ জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে পুনরুৎপাদিত জ্বালানির রূপান্তরে মনোনিবেশের কোনো বিকল্প নেই। আর তাই বাজেটে নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশে প্রণোদনামূলক করনীতি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে রাজস্ব নীতিতে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের বিকাশে বিশেষত সৌরশক্তি খাতের বিকাশের সহায়ক নীতি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। কেননা সৌরশক্তি ইউনিট স্থাপনের জন্য যে সোলার প্যানেল, ইনভার্টার, এবং মাউন্টিং স্ট্রাকচার আমদানি করতে হয় সেগুলোর ওপর আরোপিত বিভিন্ন শুল্ক ও করের পরিমাণ ওই সব পণ্যের ঘোষিত আমদানি মূল্য -এর ২৬ থেকে প্রায় ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত। এসব পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক ও কর বহাল থাকায় এ খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং বৃহত্তর অর্থে জনগণ সবুজ জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ হারাচ্ছেন। জীবাশ্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে সবুজ জ্বালানিভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাই সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা এই কর ও শুল্কগুলো প্রত্যাহার বা অন্তত উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনার পক্ষে। স্বভাবতই শুল্ক ও করগুলো প্রত্যাহার করা হলে উল্লিখিত যন্ত্রাদি আমদানির খরচ কমবে, আর তাতে গ্রাহক পর্যায়ে সৌরশক্তিভিত্তিক সিস্টেমগুলোর খুচরা মূল্যও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে আসবে।
কর ও শুল্কগুলো পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হলে বা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনলে গ্রাহক পর্যায়ে দাম কতোটা কমবে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ সোলার এন্ড রিনিউয়েবল এনার্জি এসোসিয়েশন (ইঝজঊঅ) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেয়া যেতে পারে। বিএসআরইএ-এর তথ্যানুসারে সোলার প্যানেলের শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করলে সোলার সিস্টেমের খরচ ১১ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। সোলার ইনভার্টারের শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করলে পুরো সিস্টেমের খরচ সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। এজন্যে সোলার এনার্জি সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য আলাদা এইচএস কোড ব্যবহার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। লিথিয়াম ব্যাটারি আমদানির জন্যও আলাদা এইএস কোড দরকার। তা না হলে প্রথাসিদ্ধ জ্বালানির জন্য যন্ত্রপাতির জন্য দেয় শুল্ক হারেই সবুজ যন্ত্রাংশ বা পণ্যের শুল্কায়ন করা হয়। তাই এসবের দাম কমানো সম্ভব হয় না। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সৌরশক্তিভিত্তিক সিস্টেমের খরচ কমানো গেলে নিঃসন্দেহে সৌরশক্তির প্রতি উদ্যোক্তা, অর্থায়নকারি প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকদের আগ্রহ আরও বাড়বে। বাংলাদেশে সৌরশক্তি খাতের বিকাশের মাধ্যমে কেবল প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা নয়, বরং সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করারও অমিত সম্ভাবনা রয়েছে।
শিল্পখাতে নেটমিটিরিং সুযোগ চালু করে সবুজ কারখানাগুলোতে সোলার রুফটপ সলিউশন ব্যবস্থা চালু করা যাচ্ছে। এতে শিল্পখাতের সবুজায়ন কিছুটা হলেও ঘটছে। একই সুযোগ স্কুল কলেজসহ নগরের ঘর-বাড়িতে দেয়া সম্ভব। বরং ব্যক্তি ও কমিউনিটি পর্যায়ে বাড়তি প্রণোদনা দেবার সুযোগ করা যায়। যে দামে ব্যক্তি জাতীয় গ্রিডে বা ইউনিট সবুজ বিদ্যুত বিক্রি করবে তা জাতীয় গ্রিড থেকে কেনা ইউনিটের চেয়ে অন্ততঃ ২০% বেশি হওয়া উচিত। সৌরশক্তি খাতের বিকাশ ঘটলে একদিকে যেমন গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে, অন্যদিকে তেমনি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমার ফলে এ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাও জোরদার করা সম্ভব হবে। তাই রাজস্ব নীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সৌরশক্তি-সহ সম্ভাব্য সকল নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে যথাযথ নীতি-উদ্যোগ একান্ত জরুরি। এজন্যে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিসহ সকল অংশিজনকে হাতে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
পথরেখা/এআর