অর্ণব সান্যাল, পথরেখা অনলাইন : রাত হয়েছে বেশ। রাজধানী শহর। কিছু উঠতি বয়সের তরুণ তাদের এক অসুস্থ বন্ধুকে একটি মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিল পেটের সমস্যার কারণে। হঠাৎ, তারা শুনতে পায় আবছা হইচই, মানুষের চিৎকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই আবছা চিৎকার দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চারপাশের বিভিন্ন বাসা-বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে দলে দলে মানুষ নামতে থাকে, জড়ো হতে থাকে। বন্ধুকে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া ওই তরুণেরা তখন সন্ত্রস্ত মনে বাইরে বের হয়ে এত হট্টগোলের কারণ খুঁজতে চায়। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুরির অভিযোগ তুলে কয়েকটি ছেলেকে স্রেফ পিটিয়ে মারা হয়ে গেছে! হাতের কাছে যা ছিল, তাই দিয়ে ওদের পেটানো হয়েছে, কোপানো হয়েছে। এই তথ্যগুলো দেওয়ার সময় স্থানীয়রা অবশ্য অত্যন্ত ভাবলেশহীন ছিলেন। যেন এভাবে মানুষ মারা কোনো বিষয়ই নয়!
এই ঘটনাটি
কাম্পালার একটি উপশহরের।
পূর্ব আফ্রিকার একটি ভূমিবেষ্টিত দেশ উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল এই দেশটিকে অভিহিত করেছিলেন ‘দ্য পার্ল অব আফ্রিকা’ নামে। কুখ্যাত স্বৈরশাসক ইদি আমিনের দেশ হিসেবেও উগান্ডা পরিচিতি পেয়েছিল একসময়। সেসব অবশ্য বেশ আগের কথা। তবে বলতেই হয় যে, মবের দেশ বা মবের মারে মানুষের মরে যাওয়ার দেশ হিসেবেও উগান্ডার কুখ্যাতি আছে। কিন্তু কেন উগান্ডায় মবের এত বাড়াবাড়ি?
ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল উগান্ডা। আফ্রিকার অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশের মতো ১৯৬০-এর দশকে দেশটি ধীরে ধীরে স্বাধীনতার স্বাদ পায়। নিখুঁত তারিখটি হলো ১৯৬২ সালের ৯ অক্টোবর। নতুন প্রেসিডেন্ট হন মিল্টন ওবোতে। তবে উগান্ডার মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা ও স্বস্তি আর মেলেনি। বরং নানা সমস্যা ও সংঘাতে অশান্তির মধ্যেই কাটতে থাকে। এরপর ক্ষমতা নেন ইদি আমিন। অশান্তি রূপ নেয় অত্যাচারে। পরে ইদি আমিনের বিতাড়নে কিছুটা হলেও স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে শুরু করে। এরপরে অন্তত ইদি আমিনের মতো স্বৈরশাসককে সহ্য করতে বাধ্য হতে হয়নি উগান্ডাবাসীদের। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে আগের দৈন্যদশাও কিছুটা কেটেছে কোটি পাঁচেক জনসংখ্যার দেশটির। তবে মুক্তি মেলেনি মবের মার থেকে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেটিকে বলে ‘মব জাস্টিস’। যদিও মবের সঙ্গে জাস্টিস শব্দটি আদৌ যায় কিনা, এ নিয়েও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞই মবের সঙ্গে জাস্টিস শব্দটি বসাতে রাজি নন। তারা বলেন, এর চেয়ে মব ভায়োলেন্স বলা যুক্তিযুক্ত। কারণ এটিও অপরাধ।
কিন্তু উগান্ডায় মব জাস্টিসের মাত্রা আসলে কেমন?
এই প্রশ্নটির উত্তর জানতে বেশ কিছু গবেষণাপত্রের শরণাপন্ন হওয়া যাক। সুইডেনের ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গে ২০১০ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘MOB JUSTICE: A qualitative research regarding vigilante justice in modern Uganda’। এর লেখক ছিলেন রবিন গ্লাড, আসা স্টর্মবার্গ ও অ্যান্টন ওয়েস্টারলান্ড। সেই গবেষণপত্রে বলা হয়েছে যে, ২০০৭ সালে উগান্ডায় মব জাস্টিসে নিহত হয় ১৮৪ জন। কিন্তু ২০০৮ সালে, মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬৮ জনে। অর্থাৎ মব জাস্টিসে নিহতের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল প্রায় ১০০ শতাংশ। ২০০৮ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ জন মানুষ মরে মব জাস্টিসের কারণে। উগান্ডার পুলিশের দেওয়া সরকারি হিসাব এটি। এর বাইরে আরও কতজন নিহত হয়েছে, তা অজানাই রয়ে গেছে। কারণ উগান্ডার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রে স্বাভাবিকভাবেই এমন অনেক ঘটনা অজানা রয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
২০১০ সালের এই গবেষণার ১০ বছর পরের ঘটনাবলীর দিকে চোখ দেওয়া যাক। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্যান আফ্রিকান রিসার্চ নেটওয়ার্ক অ্যাফ্রোব্যারোমিটার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। অ্যাফ্রোব্যারোমিটার মূলত আফ্রিকা অঞ্চল নিয়ে কাজ করা একটি নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এর ৭০ নম্বর পেপারের শিরোনাম ছিল, ‘Willing to kill: Factors contributing to mob justice in Uganda’। লিখেছিলেন রোনাল্ড মাকাংগা কাকুমবা। উগান্ডার পুলিশ ফোর্সের অ্যানুয়াল ক্রাইম রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মব জাস্টিসে দেশটিতে মৃত্যুর পরিমাণ বেড়েছে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। এই ৭ বছরে সরকারি হিসাবেই দেশটিতে মব জাস্টিসে নিহত হয়েছিল ৪ হাজার ৪৭ জন মানুষ। বছরপ্রতি মৃত্যু ছিল প্রায় ৫৮০ জন। মাসপ্রতি যা দাঁড়ায় প্রায় ৪৮ জনে। অর্থাৎ, কমা তো দূরের কথা দিনকে দিন উগান্ডায় মবের মারে মানুষ মরার সংখ্যা শুধু বেড়েছেই। একদম সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে হলে উল্লেখ করা যায় উগান্ডা পুলিশ ফোর্সের ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিকে। চলতি বছরের ১৯ আগস্ট এটি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে পুলিশের পক্ষ থেকে ওই মাসেই ঘটে যাওয়া ৪-৫টি ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সবগুলোই ছিল মব জাস্টিসে কারও না কারও আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ। এগুলো উল্লেখ করে মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয় ওই বিবৃতিতে। এক্ষেত্রে পুলিশ একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে অভিহিত করে মব জাস্টিসে জড়িতদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিয়েছে।
অর্থাৎ, একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আফ্রিকার এই দেশটি কোনোভাবেই মব জাস্টিস থেকে মুক্ত হতে পারছে না। মবের মারে সেখানে মানুষ মরছে নিয়মিত বিরতিতে। সাধারণ মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে এবং কাউকে অপরাধী অভিহিত করেই তার প্রয়োগ করছে দেদারসে।
কিন্তু কেন এতদিন ধরে উগান্ডা এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে?
গবেষকেরা এক্ষেত্রে কিছু কারণ বের করেছেন। তারা বলছেন, মব জাস্টিস জন্মের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অকার্যকর বিচার বিভাগ। এই বিভাগের ওপর যখন সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে, কোনোভাবেই যখন প্রচলিত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বিশ্বাস ফেরাতে পারে না, তখনই মব নিজেরাই জাস্টিস প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। এছাড়া যখন সরকার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, তখনও মব জাস্টিস দেখা যায়। এই আইন প্রয়োগহীনতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকেরা বলছেন, যখন মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখনই তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্ররোচনা পায়। এই নিরাপত্তাহীনতা তখনই প্রবল হয়ে ওঠে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা আনুষ্ঠানিক বাহিনী এক অর্থে অকার্যকর হয়ে যায়। অর্থাৎ, এসব বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয় করে ফেলার কারণেই নিরাপত্তাহীনতার জন্ম হয়।
‘MOB JUSTICE: A qualitative research regarding vigilante justice in modern Uganda’ নামক গবেষণাপত্রের লেখকেরা আরও কিছু বিষয়কে মব জাস্টিসের কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলছেন, সীমাহীন দুর্নীতি, বেকারত্ব ও সমাজে শ্রেণিসংক্রান্ত বিভাজনও মব জাস্টিস সৃষ্টির কারণ। প্রথম দুটি কারণ তো সাদা চোখেই বোঝা যায়। দুর্নীতি ও বেকারত্ব–দুইই সামাজিক ক্ষোভের সঞ্চার করে। আর সামাজিক শ্রেণি, বিশেষ করে নিচু সামাজিক শ্রেণির মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক শিক্ষার অভাবের দরুণ বিচারিক প্রক্রিয়া উদ্ভবের কারণই বোঝেন না। গবেষকেরা বলছেন, এরা মনে করেন বিচার করা তাদেরই কাজ! মানবাধিকার বিষয়ে তাদের ধারণা খুবই কম থাকে। ফলে অপরাধী আসলেই অপরাধী কিনা, সেটি যে নির্ণয় করতে হয় এবং দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন অভিযুক্তরও যে মানবাধিকার থাকে–সে সম্পর্কেই এসব মানুষেরা অবগত থাকেন না বা বোঝেন না। ফলে মব জাস্টিস হয়ে পড়ে লাগামছাড়া।
অ্যাফ্রোব্যারোমিটারে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে আবার মব জাস্টিস বা ভায়োলেন্স সৃষ্টির কারণ হিসেবে সরকারের কর্মনৈপুণ্যহীনতাকেও কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। রোনাল্ড মাকাংগা কাকুমবা বলছেন, অপরাধের পরিমাণ কমিয়ে আনতে এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতে সরকার যখন ব্যর্থ হয়, তখন সাধারণ জনতা আস্থা হারিয়ে মব জাস্টিসে সমাধান খোঁজে।
সুতরাং, একটি বিষয় স্পষ্ট যে, প্রচলিত সরকার ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের ব্যর্থতাই মোটা দাগে মব জাস্টিস সৃষ্টির অন্যতম কারণ। অন্তত উগান্ডা সেসব কারণেই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মব জাস্টিসের নৃশংসতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। যদিও সে দেশে আইন পাস করেই মব জাস্টিস বা ভায়োলেন্সকে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করা আছে।
প্রশ্ন আসতেই পারে যে, মবের মন আসলে কেমন? একটা মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে স্রেফ হাতের কাছে যা আছে, তাই দিয়ে, প্রয়োজনে খালি হাতে-পায়ে আঘাত করতে করতে যারা মেরেই ফেলে, তাদের মনোজগতে আসলে কী চলে?
মনোবিদেরা এক্ষেত্রে কুকুরের উদাহরণ দেন। তাদের কথায়, একটা কুকুর আপনাকে রাস্তায় দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠতে পারে। কিন্তু আক্রমণ করবে একপাল কুকুর। মানুষও প্রাণি হিসেবে সেই মানসিকতা থেকে খুব একটা বাইরে যেতে পারে না। ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে যে সহজাত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তার প্রাবল্য গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অনেক বেড়ে যায়। মানুষ ব্যক্তি হিসেবে যে ধরনের কাজ করে না, করার ক্ষেত্রে মানসিক বাধা পায়, সেই একই কাজ মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধভাবে অবলীলায় করে ফেলে। কারণ মানুষ তখন ব্যক্তি হিসেবে না ভেবে, গোষ্ঠী হিসেবে ভাবে এবং সেই ভাবনায় ব্যক্তিগত বাধা আর কাজ করে না। এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় ব্যক্তি মানুষ তার নিয়ন্ত্রণও হারায়।
মবের মানসিকতা আসলে মানুষের একটি গোষ্ঠীবদ্ধ মানসিকতাই। তাই ক্রাউড মেন্টালিটি ও মব মেন্টালিটি অনেক বেশি অনুরূপ। এই গোষ্ঠীবদ্ধতার সুফল যেমন আছে, কুফলও আছে। যেমন: দাঙ্গাও একটি গোষ্ঠীবদ্ধ কর্মকাণ্ডই। কিন্তু এই দুনিয়ার ইতিহাসে আতিপাতি করে খুঁজেও কেউ কোনো শান্তিপূর্ণ দাঙ্গার উদাহরণ পাবে না। ঠিক তেমনই মবের মনও সহিংসতায় পূর্ণ, সেখানে শান্তি নিখোঁজ থাকে। আর এই গোষ্ঠীর আচরণ যদি সহিংস হয়, তবে গোষ্ঠীর আকার যত বড় হতে থাকে, সহিংসতার পরিমাণও তত বাড়তে থাকে।
মব মানসিকতা মানব ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। যুগে যুগেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মব দানা বাঁধতে দেখা গেছে। কখনও ডাইনি মারতে, কখনও ধর্মীয় বিষয়ে তিলকে তাল বানিয়ে কিংবা রাজনৈতিক বিক্ষোভের রূপে মব মানসিকতার বিস্তার হয়েছে। ট্রমা বিশেষজ্ঞ গায়ুক অং মনে করেন, এই মব মানসিকতা নানা কারণে তৈরি হতে পারে। সেসব কারণের মধ্যে আছে গোষ্ঠীতে ঢুকে ব্যক্তিগত পরিচয় হারিয়ে ফেলা, রাগ-উত্তেজনা বা হিংসার বশবর্তী হয়ে আবেগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, সাধারণভাবে অগ্রহণযোগ্য বিষয়ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা, গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে ব্যক্তির আত্মসচেতনতা হারিয়ে ফেলা, অপরাধের দায় গোষ্ঠীর ওপর চাপানোর প্রবণতা সৃষ্টি ইত্যাদি।
কোনো সমাজে মব সৃষ্টির বেশ কিছু তত্ত্ব আছে। ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার অনলাইন লাইব্রেরিতে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু নিবন্ধ আছে। সেগুলোতে বলা হয়েছে, মোটা দাগে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সমষ্টিগত আচরণের প্রকৃতি কেমন হবে বা হয়, সে সংক্রান্ত মোট ৪টি তত্ত্ব আছে। প্রথমটি হলো কন্ট্যাজিওন থিওরি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সমষ্টিগত আচরণ মূলত আবেগীয় ও অযৌক্তিক হয় এবং গোষ্ঠীর সামগ্রিক সম্মোহনী প্রভাবে তাড়িত হয়।
দ্বিতীয় তত্ত্ব হলো, কনভারজেন্স থিওরি। এই তত্ত্ব বলে, গোষ্ঠীর আচরণ আসলে সেই গোষ্ঠীতে একই মানসিকতার ব্যক্তিদের সম্মিলিত আচরণ। অর্থাৎ, এই তত্ত্ব অনুযায়ী গোষ্ঠীর আচরণ আদতে ব্যক্তিদের আচরণ বা বিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করে।
বিবেচ্য তৃতীয় তত্ত্বটি হলো এমারজেন্ট নর্ম থিওরি। এটি অনুযায়ী, গোষ্ঠীগত আচরণের ক্ষেত্রে কীভাবে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, সেটি সম্পর্কে মানুষ নিশ্চিত থাকে না। গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ যখন এ নিয়ে আলোচনা করে, তখন বিদ্যমান রীতিনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং তৎকালীন সমাজে থাকা শৃঙ্খলা ও যৌক্তিকতার মান ওই গোষ্ঠীর আচরণের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়।
চতুর্থ তত্ত্বটি হলো, ভ্যালু অ্যাডেড থিওরি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে মানুষের গোষ্ঠীগত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অভাব, কাঠামোগত ব্যর্থতা ও সাধারণ বিশ্বাসের প্রভাবে এই গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং তার আচরণ প্রকাশ্যে আসে।
আশা করা যায়, এতক্ষণে মব সৃষ্টির কারণ, সেই মব কীভাবে গঠিত হয় এবং কখন সহিংস হয়ে ওঠে–এই বিষয়গুলো মোটামুটি বোঝা গেছে। এখন বরং আবার উগান্ডায় ফেরা যাক। মবের দেশে ফিরে গিয়ে এই মব জাস্টিস ঠেকানোর উপায় নিয়ে সুলুকসন্ধান করতে তো ক্ষতি নেই!
অ্যাফ্রোব্যারোমিটারে প্রকাশিত ‘Willing to kill: Factors contributing to mob justice in Uganda’ নামক গবেষণাপত্রে মব জাস্টিস কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। এই সুপারিশগুলো এতটাই যৌক্তিক যে মব জাস্টিসের বাড়বাড়ন্ত দেখা দেওয়া সব দেশেই এর প্রয়োগ করা যায়। এগুলো হলো:
এক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আদালতের প্রতি জনমানুষের আস্থা ফেরাতে দুর্নীতির পরিমাণ কমিয়ে আনা। একইসঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটার পর সেগুলো সামাল দিতে হবে স্বচ্ছ উপায়ে।
দুই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে জনসাধারণের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এই আস্থা ফেরাতে না পারলে কোনোভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
তিন, বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও গতিশীল করতেই হবে। নইলে সাধারণ মানুষ বিচার ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে পাবে না।
চার, অপরাধমূলক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে যেমন আইনি প্রক্রিয়া কার্যকর থাকে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে শিক্ষিতও করে তুলতে হবে। এ বিষয়ে অনেক মানুষই অজ্ঞ থাকে। এবং তা থেকে মব জাস্টিসও সৃষ্টি হতেই পারে। তাই এ নিয়ে মানুষকে জানাতে হবে। নাগরিক বানাতে হলে জনসাধারণকে নাগরিক হওয়ার শিক্ষাও দিতে হবে।
সবশেষে বলতেই হয় যে, ওপরের এসব সুপারিশ সবক্ষেত্রে কার্যকর থাকে না বলেই উগান্ডার মতো দেশগুলোতে মব জাস্টিস বা ভায়োলেন্স এতটা প্রকট হয়ে ওঠে। এতে একসময় ওইসব দেশের পুরো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই ভেঙে পড়ে। আর সেটি যখন হয়, তখন একটি সত্যিকারের রাষ্ট্র বা দেশ হয়ে ওঠে তাসের ঘরের মতো, যা একটি টোকায় ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
পথরেখা/এআর