পথরেখা অনলাইন : একটা সময় ছিল যখন প্রযুক্তি বিশ্বে অসম্ভবকে সম্ভব হতে দেখা যেত অনেক দিন পর পর। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তির কল্যাণে এখন প্রায় প্রতিদিনই অসম্ভবকে সম্ভব হতে দেখা যাচ্ছে। উন্নত এআই মডেল তৈরিতে শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে নিয়মতি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রায় নিয়মিতই আসছে নিত্যনতুন সব এআই টুল ও ফিচার, যেখানে অনুঘটকের ভূমিকায় থাকছে উন্নত সব এআই মডেল।
সম্প্রতি আমেরিকান টেক জায়ান্ট মেটা স্ব-শিক্ষায় পারদর্শী একটি এআই মডেল নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে। গত শুক্রবার তাঁরা বেশ কয়েকটি নতুন এআই মডেল নিয়ে এসেছে যার মধ্যে একটি অন্যান্য এআই মডেলের কাজ মূল্যায়ন করতে সক্ষম। অর্থাৎ এই মডেলটি নিজেই নিজেকে শেখাতে সক্ষম। এই ধরণের মডেলের কল্যাণে ভবিষ্যতে এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের সম্পৃক্ততা অনেকাংশে কমে যেতে পারে।
গত আগস্টে প্রকাশিত মেটার একটি গবেষণাপত্রে এই এআই টুলটির কথা প্রথম উল্লেখ করা হয়। সেখানে নতুন এই মডেলটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর পাশাপাশি এও বলা হয় যে, মডেলটি তৈরিতে ‘চেইন অব থট’ বা শৃঙ্খলাবদ্ধ চিন্তার কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ওপেনএআই-এর সম্প্রতি প্রকাশিত ০১ মডেলগুলোতেও এই একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। ‘চেইন অব থট’ কৌশল প্রয়োগ করায় এআই মডেলগুলো অন্যান্য এআই মডেলের পারফর্মেন্স মূল্যায়নে পারদর্শী হয়ে উঠে।
‘চেইন অব থট’ কৌশল আসলে কী, কিভাবে কাজ করে?
‘চেইন অব থট’ প্রক্রিয়াটি বেশ মজার। এখানে জটিল কোনো সমস্যাকে ছোট ছোট যৌক্তিক ধাপে ভাগ করে প্রতিটি ধাপ এক এক করে সমাধানের মাধ্যমে সমস্যাটির পূর্ণাজ্ঞ সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। ফলে বিজ্ঞান, গণিত ও কোডিং এর মতো চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলোর জটিল সমস্যার নির্ভুল সমাধানে ‘চেইন অব থট’ কৌশলে তৈরি এআই মডেলগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পারদর্শী।
উল্লেখ্য, মেটার এই মূল্যায়নকারী (বা ইভালুয়েটর) মডেলটির প্রশিক্ষণে গবেষকরা এআই দিয়ে তৈরি (এআই জেনারেটেড) ডেটাই ব্যবহার করেছেন। ফলে মডেলটির প্রশিক্ষণেও মানুষের সম্পৃক্ততা প্রায় ছিল না বললেই চলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এআই মডেলগুলোর এই উন্নয়ন তথা সার্বিক এআই গবেষণা কি তাহলে ‘অটোনোমাস এআই’ প্রযুক্তির দিকেই ধাবিত হচ্ছে।
‘অটোনোমাস এআই’ কী?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তিরই একটি শাখা হচ্ছে অটোনোমাস এআই। এই প্রযুক্তিতে তৈরি সিস্টেম বা টুলগুলো নিজেরাই নিজেদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে, নিজেদের করা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পারফর্মেন্সের উন্নতি ঘটাতে পারে। এছাড়া বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নিজেরাই নিতে পারে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত। অটোনোমাস এআই-ভিত্তিক টুল বা সিস্টেমগুলো সাধারণ কাজ থেকে শুরু করে জটিল কাজ সম্পাদনেও পারদর্শী। পাশাপাশি মানুষের সীমিত হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণেই কাজ করতে পারে অটোনোমাস এআই মডেলগুলো। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে হিউম্যান ইনপুট বা মানুষের কোনো ইনপুট দেওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না। সার্বিকভাবে তাই অটোনোমাস এআই প্রযুক্তিকে স্বনির্ভর বলা যেতে পারে।
সবথেকে বড় কথা, অটোনোমাস এআই দিয়ে তৈরি টুল বা সিস্টেম প্রতিনিয়ত নিজের উন্নতি করতে পারে। পাশাপাশি একাধিক টুল যদি পরস্পর ‘কানেক্টেড’ থাকে তাহলে নেটওয়ার্কের একটি টুলের উন্নতি অন্যগুলোতেও প্রতিফলিত হয়। একটির ভুল থেকে আবার অন্যটি শিক্ষা নিয়ে থাকে। ফলে সবগুলোর পারফর্মেন্সেই ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়।
অটোনোমাস এআই প্রযুক্তির ব্যবহার
অটোনোমাস এআই নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণাই আমূল পালটে দিতে পারে এই প্রযুক্তি। এই যেমন সম্প্রতি ইলন মাস্কের টেসলা তাঁদের বহুল আলোচিত রোবোট্যাক্সি ‘সাইবারক্যাব’ উন্মোচন করেছে। যদিও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসতে চালকবিহীন এই গাড়িকে এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। কিন্তু আজ থেকে ৪-৫ বছর আগেও সাইবারক্যাবের মতো চালকবিহীন, স্টিয়ারিং হুইলবিহীন একটি গাড়ির কথা আমরা হয়তো কল্পনাও করতে পারতাম কিনা।
একইভাবে হিউম্যানয়েড রোবোটেও ব্যবহৃত হতে পারে অটোনোমাস এআই। টেসলাই সম্প্রতি ‘অপটিমাস’ নামের বহুল আলোচিত একটি হিউম্যানয়েড রোবোট উন্মোচন করেছে যেটি হুবহু মানুষের মতোই চলাচল করতে পারে, কথা বলতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে, দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে মানুষকে সহায়তা করতে পারে।
অটোনোমাস গাড়ি ও হিউম্যানয়েড রোবোটের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গ্রাহকসেবা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থ ও ম্যানুফ্যাকচারিংসহ বিভিন্ন সেক্টরকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম অটোনোমাস এআই প্রযুক্তি।
AI (Artificial Intelligence)অটোনোমাস এআই প্রযুক্তির সম্ভাবনা যেমন বিশাল, আশঙ্কার দিকগুলোও কোনোভাবেই কম গুরুতর নয়। ছবি: রয়টার্স
অটোনোমাস এআই নিয়ে সমালোচনার জায়গাটা কোথায়?
কোনো সন্দেহ নেই অটোনোমাস এআই আধুনিক প্রযুক্তির সংজ্ঞাই আমূল বদলে দিতে পারে। আর তাই যদি হয়, তাহলে এই প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বজুড়ে এতো সব আলোচনা-সমালোচনা কেন? আসলে এর নামের মধ্যেই আশঙ্কা বা ভয়ের কারণটা লুকায়িত। অটোনোমাস অর্থই হচ্ছে স্ব-নিয়ন্ত্রিত বা স্ব-চালিত, অর্থাৎ যেখানে নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয় না।
যেমনটা আগেই উল্লেখ করেছি, এই প্রযুক্তিতে তৈরি সিস্টেম বা টুলগুলোর পরিচালনায় মানুষের নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই কম, অনেক ক্ষেত্রে এমনকি নেই বললেও চলে। ফলে প্রযুক্তিবিদদের অনেকেই অটোনোমাস এআই-এর ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে বিভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে এই প্রযুক্তিতে তৈরি কোনো সিস্টেম বা টুল যদি কখনও ‘সেলফ-ডেভেলপ’ ফিচারটির সুযোগ নিয়ে নিজের সক্ষমতাকে এমন একটি উচ্চতায় নিয়ে যায় যেখানে মানুষের অস্তিত্বই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে তাহলে তো আর বিপদের শেষ নেই। এক্ষেত্রে কোনো একটি সিস্টেমের সামান্যতম ‘ম্যালফাংশন’ পুরো মানব জাতির জন্য এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
আবার নীতিজ্ঞান বিবর্জিত এক বা একাধিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দেশও চাইলে অটোনোমাস এআই-কে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় মানুষই কোটি মানুষের বিপদের কারণ হবে।
অবশ্য এআই-এর কারণে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের বিষয়টি অনেকের কাছে এখনও কল্পকাহিনীর অংশ বলেই মনে হতে পারে। তাদেরকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করাতে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি।
বিবিসি’র বরাত দিয়ে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান সাকস বলছে, এআই প্রযুক্তি ভিত্তিক বিভিন্ন টুল ও সার্বিক অটোমেশনের কারণে সারা বিশ্বে ৩০০ মিলিয়ন মানুষের চাকরি চলে যেতে পারে। এসইও ডট এআই-তে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এআই প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০০ মিলিয়ন চাকরি বাজার থেকে নাই হয়ে যেতে পারে, এবং ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে এআই-এর প্রভাব ১৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
Meta AIমেটার নতুন এআই মডেল যেন ভবিষ্যতের অটোনোমাস এআই প্রযুক্তিরই জানান দিচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
মেটার এআই গবেষণার লক্ষ্য কি অটোনোমাস এআই?
স্ব-শিক্ষায় পারদর্শী মেটার এআই মডেলটি তৈরির সাথে যুক্ত দু’জন গবেষক জানিয়েছেন, তাঁদের তৈরি মডেলটি ভবিষ্যতে অটোনোমাস এআই এজেন্ট কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা দিচ্ছে। মেটার এই মডেলটি অন্য এআই মডেলগুলোর পারফর্মেন্স মূল্যায়ন করতে সক্ষম। ভবিষ্যতে অটোনোমাস এআই-ভিত্তিক মডেল নিজেই নিজের পারফর্মেন্স মূল্যায়ন করে নিজের ভুল থেকে নিজেই শিখতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে প্রচলিত এআই মডেলগুলোর প্রশিক্ষণে ‘রিএনফোর্সমেন্ট লার্নিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেখানে এক বা একাধিক এআই বিশেষজ্ঞের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে ডেটা লেবেলিং করতে এবং গণিত ও রাইটিং সম্পর্কিত প্রশ্নের (কুয়েরির) উত্তর যাচাই করতে হিউম্যান ইনপুট ও ফিডব্যাকের কোনো বিকল্প নেই। ফলে এই প্রক্রিয়া একদিকে ব্যয়বহুল অন্যদিকে সময়সাপেক্ষও বটে।
এআই জগতে তাই এখন অনেকেরই লক্ষ্য মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে সক্ষম এমন এআই মডেল তৈরি করা। দিনরাত গবেষণাও চলছে এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। নিঃসন্দেহে অটোনোমাস এআই দারুন সব ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে আমাদের জীবনে। কিন্তু এই প্রযুক্তির উত্তরোত্তর উন্নয়ন যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল এর সম্ভাব্য ঝুঁকিসমূহ নিরূপণ করে এর নিয়ন্ত্রণে (রেগুলেশনে) যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, টেক ক্রাঞ্চ, দ্য ভার্জ, ওপেনএআই, টেকটার্গেট
পথরেখা/এআর