দেশকন্ঠ ডেস্ক : দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় খুদে শিক্ষার্থীদের পুষ্টি নিশ্চিত ও ঝরে পড়া কমাতে উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন বিস্কুট বিতরণ করা হয়। সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও অনিয়মে এ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মেয়াদ শেষে তিন দফায় প্রায় দুই বছর প্রকল্পের সময় বাড়ালেও সেটি শেষ হয়েছে। নতুন করে শুরু করতে এখন পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হয়নি বলে জানা গেছে।
জানা যায়, শিক্ষার্থী ভর্তি ও শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির হার বাড়ানো এবং ঝরে পড়া রোধ—প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে এমন বেশকিছু লক্ষ্য অর্জনে ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। এরপর দফায় দফায় সংশোধনী এনে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় দফায় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ায় সরকার। মেয়াদ বৃদ্ধির প্রতি দফায় শিশুদের খাবার প্রদানের জন্য নতুন আরেকটি প্রকল্প প্রণয়ন করার শর্ত দেওয়া হলেও তৃতীয় দফায় মেয়াদ গত মাসের ৩০ জুন শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ডিপিপি প্রণয়নের কাজ এখানো শুরু হয়নি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের নানা পজিটিভ দিক রয়েছে। পৃথিবীব্যাপী গবেষণায় সেটি উঠে এসেছে। বর্তমানে এ কার্যক্রমের তিন দফায় বাড়তি মেয়াদ শেষ হলেও নতুন প্রকল্প শুরু করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম নতুনভাবে শুরু করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠালে সেখান থেকে একটি ফিজিবিলিটি (সম্ভাব্যতা) স্টাডির জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয়। সেটি তৈরির পর নতুন করে ডিপিপি তৈরি করতে হবে। সেটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। যদি সেখানে কোনো অসঙ্গতি থাকে তবে সংশোধনের জন্য পাঠানো হবে। এরপর সেটি অনুমোদন দেওয়ার পর অফিস ও জনবল নিয়োগ করে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। ঈদের পর এ কার্যক্রম শুরু করা হলেও এতে ন্যূনতম পরবর্তী বছর প্রয়োজন হবে। সে কারণে আগামী এক বছর এ কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিই’র মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. মহিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, স্কুল ফিডিংয়ের তৃতীয় ধাপের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে নতুন প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইমূলক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এজন্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে সম্মতি জানিয়েছে। তিনি বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শেষে নতুন করে ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আশা করি আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে নতুন করে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, স্কুল ফিডিংয়ের মাধ্যমে বিস্কুট বিতরণের সফলতা থেকে সারাদেশের প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার দিতে প্রণয়ন করা হয় ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা-২০১৯’। নীতিমালা অনুযায়ী ‘প্রাইমারি স্কুল মিল প্রকল্পটি গত ১ জুন একনেকে উত্থাপন করা হয়। শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার খিচুড়ি দেয়ার প্রস্তাব করায় প্রধানমন্ত্রী ডিপিপি সংশোধন করে কার্যকর ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এর আগে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশে সফর রাখায় একনেক থেকে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়।
স্কুল ফিডিংয়ের তৃতীয় ধাপের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে নতুন প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইমূলক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এজন্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে সম্মতি জানিয়েছেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার কিছু দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুলের শিশুদের গুঁড়ো দুধ দেওয়া শুরু করে। ১৯৯৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলের জন্য খাদ্য কর্মসূচি চালু করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের চাল, ডাল ও নগদ অর্থ দেওয়া হতো। পরে ২০০০ সালের পর থেকে এসবের বদলে ভিটামিনসমৃদ্ধ বিস্কুট দেওয়া হতো। ২০০২ সালে যশোরে বন্যাকবলিত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি সাহায্য হিসেবে বৃহৎ পরিসরে স্কুলে খাওয়ানো কর্মসূচি চালু করা হয়।
জানা গেছে, দেশের ১০৪টি উপজেলায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। তার মধ্যে ৯৪টি সরকারি অর্থায়নে আর ১০টি উপজেলায় বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ফিডিং কর্মসূচিতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ১৯৯০ সাল থেকে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী স্কুল ফিডিং কর্মসূচি থেকে উপকৃত হয়েছে।
দেখা গেছে, ১৪টি উপজেলায় শিশুরা রান্না করা খাবার পেত। বাকি সব এলাকায় তাদের ৭৫ গ্রাম ওজনের ভিটামিনসমৃদ্ধ বিস্কুট দেওয়া হতো। তিন দফায় ১৮ মাস মেয়াদ শেষ করেও এ প্রকল্পে এখানো ২৫০ কোটি টাকার বেশি অব্যয়িত অর্থ রয়ে গেছে, যা দিয়ে আরও ছয় মাস বিস্কুট বিতরণ করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের নানা পজিটিভ দিক রয়েছে। পৃথিবীব্যাপী গবেষণায় সেটি উঠে এসেছে। বর্তমানে এ কার্যক্রমের তিন দফায় বাড়তি মেয়াদ শেষ হলেও নতুন প্রকল্প শুরু করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, স্কুল ফিডিং থেকে বড় তিন ধরনের লাভ হয়। তার মধ্যে করোনা-পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে পুষ্টিহীনতা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিতরণ করা বিস্কুটে উচ্চমানসম্পন্ন পুষ্টি থাকে। এমনিতে আমাদের শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এসব বিস্কুট খেলে তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়। এর বাইরে শিশুদের ঝরে পড়ার হার কমে যায় ও খাদ্য বিতরণের কারণে স্কুলে এক ধরনের আনন্দ তৈরি হয়। এতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ফল বাড়ে।
রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম বন্ধ হলে প্রাথমিকে এই তিনটি হারিয়ে যাবে। শিশুরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়বে। দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্প আছে, শিক্ষায় স্কুল ফিডিং একটি মেগা প্রকল্প হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশকন্ঠ/রাসু