মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল : স্বাগতিক দেশ হিসেবে ভারতকে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় ফেবারিট হিসেবে ধরা হয়েছিল। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মিল রেখে গ্রুপ পর্বে ৯ ম্যাচের পর সেমিফাইনাল মিলিয়ে ১০ ম্যাচে অপরাজিত তারা। অন্যদিকে শুরুতে হারলেও পরে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে দারুণ খেলছে অস্ট্রেলিয়া। তাদের হেক্সা মিশনে প্রতিপক্ষ ভারত। অন্যদিকে ভারতের তৃতীয় শিরোপা জয়েও বাধা অজিরা।
এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান ভারতের বিরাট কোহলির। সবচেয়ে বেশি উইকেট ভারতের মোহাম্মদ শামির। ১০ ম্যাচে ৭১১ রান কোহলির, গড়, ১০১.৫৭। আর ৬ ম্যাচ খেলা শামির উইকেট ২৩, বোলিং গড়, ৯.১৩। শুধু কোহলি কিংবা শামিই নন, এই বিশ্বকাপে দারুণ ফর্মে ভারতের অন্য তারকারাও। এই বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ রানসংগ্রহকারীর তালিকায় কোহলি ছাড়াও রয়েছেন রোহিত শর্মা (৫৫০)। সেরা পাঁচ উইকেট শিকারির তালিকায়ও একাধিক ভারতীয়, শামি ছাড়াও রয়েছেন ১৮ উইকেট নেওয়া জসপ্রীত বুমরা। ভারতীয় ক্রিকেটারদের এসব পরিসংখ্যান এখানে দেওয়ার কারণ এটা বোঝাতে যে, দল হিসেবে অবিশ্বাস্য ফর্মে ভারত। আশির দশকের দোর্দন্ত প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথাই বলুন, কিংবা বিশ্ব ক্রিকেটের ওপর ছড়ি ঘোরানো অস্ট্রেলিয়ার কথাই বলুন, সুসময়ে দুই দলেরই ছিল দারুণ ওপেনিং জুটি আর শক্তিশালী টপ অর্ডার। এই বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের ওপেনার ও পারফরম্যান্স ক্লাইভ লয়েডের সেই উইন্ডিজ কিংবা স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
শুধু টপ অর্ডারই নয়, ভারতীয় দলের ব্যাটিং লাইনআপের এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত ব্যাটারের পারফরম্যান্সও দেখুন। ভারতীয় দলের হয়ে এক থেকে পাঁচে ব্যাট করছেন, রোহিত শর্মা, শুভমান গিল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ার ও লোকেশ রাহুল। এই বিশ্বকাপে তাদের ব্যাটিং গড় যথাক্রমে ৫৫.০০, ৫০.০০, ১০১.৫৭, ৭৫.১৪ ও ৭৭.২০! প্রথম পাঁচ ব্যাটারের এমন উদ্ভাসিত পারফরম্যান্সের কারণে এই বিশ্বকাপে বলতে গেলে তেমন কোনো পরীক্ষায় পড়তে হয়নি ভারতের ব্যাটিং লেজকে। যেমনটি পড়তে হয়েছে সেমিফাইনাল খেলা অন্য তিন দল নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে। শুধু কি ব্যাটিং, বোলিংয়েও দুর্দান্ত করছেন ভারতীয় বোলাররা। বল হাতে বুমরা ও সিরাজের শুরু, সেটা এখন পর্যন্ত খুব বেশি ভয়ঙ্কর না হলেও প্রথম পরিবর্তিত বোলার হিসেবে এসেই বাজিমাত করে চলেছেন লম্বা বন্ধুর পথ মাড়িয়ে আসা শামি। ভাবা যায়, এই বিশ্বকাপেই তিনবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন তিনি! সেরা পাঁচ বোলিংয়ের তিনটিই তার! আর বুধবার শচীন টেন্ডুলকারের ঘরের মাঠে কোহলির বিরাট কীর্তি গড়ার ম্যাচে ৫৭ রানে যে ৭ উইকেট নিলেন শামি, বিশ্বকাপের তো বটে, ওয়ানডে ক্রিকেটেই কোনো ভারতীয় বোলারের সেরা বোলিং।
সে কারণেই তাঁকে নিয়ে পাকিস্তানের বোলিং কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরাম তো আর এমনি এমনিই বলেননি, ‘আমি এত ভালো সিমে কাউকে বল করতে দেখিনি।’ তো রোববারের আহমেদাবাদের ফাইনালের এই ভারতকে আটকাবে কে? দ্বিতীয় সেমিফাইনাল জিতে যে দলই ফাইনালে যাক, এই ভারতকে নিয়ে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়বেই। ব্যাটিংয়ে রোহিত-কোহলিদের আটকাবে না বোলিং বুমরা-শামিদের; প্রতিপক্ষের ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র অবস্থাই কল্পনা করছেন কেউ কেউ। তাহলে তো ভারতই চ্যাম্পিয়ন! সেটিও আবার বলা যাচ্ছে না। অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটে আগাম কিছু বলার জো নেই। এক ওভারে তিন-চারটি উইকেট পড়তে পারে, যেকোনো পরিস্থিতিতে ঘুরে যেতে পারে ম্যাচের মোড়। তা ছাড়া এই যে একের পর এক ম্যাচ জিতে ভারত দশে দশ, মসৃণ এই পথচলায় তাদের কোনো পরীক্ষায়ই পড়তে হয়নি। দলীয় ক্রিকেটারদের ফর্ম অবশ্যই এর বড় কারণ। তবে ওয়াংখেড়ের ফাইনালে প্রতিপক্ষের ভরসা এটাই, সব দিন একই ফর্ম সবার থাকে না!
১৯৮৩ ও ২০১১ সালের পর তৃতীয় শিরোপা জয়ের টার্গেটে খেলবে ভারত। অস্ট্রেলিয়া খেলবে ১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১৫ সালের ষষ্ঠ শিরোপা জিততে। ভারত আরও একবার ফাইনাল খেলেছিল। ভারত এর আগে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে ১৯৮৭, ১৯৯৬ ও ২০১১ সালে। এবারই প্রথমবার একক আয়োজক। দেশটির ১০টি শহর বিশ্বকাপের দলগুলোকে আতিথেয়তা দিয়েছে। বিশ্বকাপের ফাইনাল এবারই প্রথম হচ্ছে ভারতের সপ্তম বৃহত্তম নগরী আহমেদাবাদে। ৬০০ বছরের পুরনো শহরটি প্রস্তুত ফাইনালের জন্য। ফাইনালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও উপস্থিত থাকতে পারেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো কিংবদন্তীরা। ম্যাচ শুরুর আগে স্টেডিয়ামের ওপর দিয়ে ১০ মিনিটের একটি রঙের খেলা খেলবে বিমান বাহিনীর বিশেষ বাহিনী। আহমেদাবাদের গোড়াপত্তন নিয়ে দারুণ একটি গল্প চালু রয়েছে। নগরবাসী এটা বলতে খুব গর্ববোধ করে। চৌদ্দ শতকে সালতানাতের সুলতান আহমেদ শাহ সাবরমতী নদীর তীরে তাঁবু খাটান। এবারের ফাইনালটি ভারতের জন্য প্রতিশোধেরও। অস্ট্রেলিয়া আরও দুবার ফাইনাল খেলেছিল। ১৯৭৫ সালে লর্ডসে প্রথম বিশ্বকাপে ১৭ রানে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। ১৯৯৬ সালে করাচিতে প্রীলঙ্কার কাছে হেরেছিল ৭ উইকেটে। দুই দলই এবার বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া।
বিশ্বকাপের ফাইনালে আম্পায়ার হিসেবে দুই অভিজ্ঞ আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ ও রিচার্ড কেটলবরা দায়িত্ব পালন করবেন। সাধারণত বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে দায়িত্ব পালন করেন এই দুই ইংলিশ আম্পায়ার জুটি। এটি হবে কেটলবরার দ্বিতীয় ফাইনাল। এর আগে তিনি ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেবার মাঠে তার সঙ্গী ছিলেন কুমার ধর্মসেনা। কেটেলবরার পাশাপাশি ইলিংওয়ার্থের জন্যও এটি হবে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল। অবশ্য ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে প্রথম। ফাইনালে জোয়েল উইলসন থাকবেন তৃতীয় আর চতুর্থ আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করবেন ক্রিস গ্যাফানি। ম্যাচ রেফারি হিসেবে আছেন অ্যান্ডি পাইক্রফট। এছাড়া বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন দেশটির সংগীত শিল্পী ও সুরকার প্রীতম। এছাড়া ইন্দো-কানাডিয়ান সিঙ্গার জোনিতা গান্ধী, অমিত মিশ্রা, শ্রীরামা চন্দ গানে কণ্ঠ দেবেন।
পথরেখা/আসো