দক্ষিণ আফ্রিকা : ৩৮২/৫; ৫০ ওভার
ওভার বাংলাদেশ : ২৩৩/১০, ৪৬.৪ ওভার
ফল : দক্ষিণ আফ্রিকা ১৪৯ রানে জয়ী
আরিফ সোহেল
দক্ষিণ আফ্রিকার পাহাড়ে চড়া রান। তার বিপরীতে শুরুতেই ধাক্কার পর ধাক্কা। সেখানে প্রাপ্তি শুধু মাহমুদ উল্লাহর সেঞ্চুরি। এমন মহাচাপেও মাহমুদ উল্লাহ প্রমাণ করেছেন তিনি দুঃসময়ের কাণ্ডারি। অথচ এবার বিশ্বকাপে তাকে রাখাই হচ্ছিল না।
দক্ষিণ আফ্রিকার ৩৮২ রানের জবাবে শেষমেশ মাহমুদ উল্লাহর অনবদ্য ১১১ রানে বাংলাদেশের হারটা লজ্জার তলানীতে ডুবেনি। ২০ বল আগে বাংলাদেশ অল আউট ২৩৩ রানে। জয়ের সমীকরণ ১৪৯ রান। এমন হারের পরও ইতিহাসে মাহমুদ উল্লাহ কাব্যকথা থাকবেই।
বড় রানের টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে বেদিশা হয়ে পড়েছিল ব্যাটাররা। দক্ষিণ ব্যাটিং তাণ্ডব দেখার পর মনে হয়েছিল বাংলাদেশও পারবে। কিন্তু তা সবটাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তবে বুক চিতিয়ে উপেক্ষিত সেই মাহমুদ উল্লাহই দলের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দলকে বিপদ থেকে বাঁচাতে নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছেন। বড় লজ্জা থেকে বাঁচাতে হারের ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করছেন সেই মাহমুদ উল্লাহই। আর আউট হওয়ার আগে দলের হয়ে আরেকটি সন্মানের সেঞ্চুরি করেছেন। অপর প্রান্তের ব্যাটারদের লম্বা সঙ্গী অনুভব করেছেন। কিন্তু নিজের ব্যাটিং চালিয়ে গেছেন দুর্দান্ত।
পাহাড়ে ওঠার পথে একের পর এক ব্যাটার সাজঘরের পথ ধরছেন নতুজানু হয়ে। আগের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ফিফটি করেছিলেন তানজিদ হাসান তামিম। কিন্তু পরের ম্যাচেই সেই ব্যর্থতা। মার্কো জানসেনের শর্ট ডেলিভারিতে ব্যাট ছুঁইয়ে ফিরলেন ১৭ বলে ১২ করে। পরের বলে আরও এক উইকেট। এবার নাজমুল হোসেন শান্ত লেগ সাইডে বেরিয়ে যাওয়া বলে ব্যাট ধরে দিলেন, এবার উইকেটরক্ষকের ক্যাচ। গোল্ডেন ডাকে (১ বলে ০) সাজঘরে শান্ত। এরপর সাকিব আল হাসান প্রথম স্লিপে ক্যাচ দেন লিজার্ড উইলিয়ামসের বলে। ৪ বল খেলে ১ রান করে ফিরেছেন অধিনায়ক। মুশফিকুরও পারেননি। মিস্টার ডিপেন্ডেবলখ্যাত এই ব্যাটারও বাজে শট খেলে উইকেট বিলিয়ে দিলেন। কোয়েতজের শর্ট আর ওয়াইড বলটিতে শট খেলে থার্ড ম্যানে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন মুশফিক। ১৭ বলে তার ব্যাট থেকে আসে ৮ রান। চোখ ছিল লিটন দাসের ওপর। কিন্তু তিনিও সেট হয়ে ফিরলেন সাজঘরে। ৪৪ বলে ২২ রান করে হলেন কাগিসো রাবাদার বলে এলবিডব্লিউ। ৫৮ রানে পঞ্চম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। জুটি বাধলেন মাহমুদ উল্লাহ-মিরাজ। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজ ১৯ বলে ১১ রান করে কেশভ মহারাজকে উইকেট দিয়ে ফিরলেন। অন্যপ্রান্ত মাটি কামড়ে আগলে রেখে, মারার বল দেখে-শুনে মারছিলেন মাহমুদ উল্লাহ। তাকে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন লেজের নাসুম [১৯] ও হাসান [ ১৫]। তাতেই সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন। দলীয় ৫৮/৫; মিরাজ আউট হওয়ার পর বাংলাদেশ ২৩৩ রান করবে এটা ছিল অভাবিত। এর সবটাই করেছেন মাহমুদ উল্লাহ। ৮১ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার জয় মনে হচ্ছিল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তা হতে দেননি মাহমুদ উল্লাহ। শেষ ৪ উইকেট জুটিতে বাংলাদেশ যোগ করেছে ১৫২ রান। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারানোর পর টানা চারটি ম্যাচ হারল বাংলাদেশ। সেমিফাইনালের স্বপ্নটা যে কার্যত শেষ। রানরেটের হিসাবে এখন পয়েন্ট তালিকার তলানীতে বাংলাদেশ।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। দ্বিতীয় ওভারের পঞ্চম বলেই ক্যাচ দিয়েছিলেন রিজা হেনড্রিকস। দক্ষিণ আফ্রিকান ওপেনারকে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো তানজিদ হাসান তামিম বলটিকে হাতের তালুতে জমিয়ে রাখতে পারেননি। যার ফলে শুরুতেই ব্রেক থ্রু পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ব্রেক থ্রু আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। সপ্তম ওভারের প্রথম বলেই সেই একই ব্যাটার রিজা হেনড্রিকসকে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে বোল্ড করেন পেসার শরিফুল ইসলাম। শরিফুলের ফুল লেন্থের বল ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন রিজা। কিন্তু বলের গতি মিস করেন তিনি। সোজা গিয়ে স্ট্যাম্পে আঘাত হানে সেটি। ৩৩ রানে প্রথম উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। আর অষ্টম ওভারের পঞ্চম বলে এলবিডব্লিউর শিকার হন আরেক মারকুটে প্রোটিয়া ব্যাটার রসি ফন ডার ডুসেন। মিরাজের স্ট্রেইট বল মিস করেন ডার ডুসেন। বল সোজা আঘাত হানে প্যাডে। জোরালো আবেদনে সাড়া দেন আম্পায়ার। ৩৬ রানে পড়ে দ্বিতীয় উইকেট। তবে সেখান থেকে কুইন্টন ডি কক আর এইডেন মার্করাম গড়ে দেন শতরানের জুটি। এই জুটি ক্রমেই বড় হচ্ছিল। অবশেষে ১৩৭ বলে গড়া ১৩১ রানের বড় জুটিটি ভাঙেন টাইগার অধিনায়ক। মার্করাম লংঅনে তুলে মারতে গিয়েছিলেন সাকিবকে। লিটন দাস নেন সহজ ক্যাচ। ৬৯ বলে ৭ বাউন্ডারিতে ৬০ রান করে সাজঘরে ফেরেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। তবে ডি কককে আটকানো যায়নি।
এবারের বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের পঞ্চম ম্যাচে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেন মারকুটে এই ওপেনার। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের যেটি ডি ককের ২০তম সেঞ্চুরি। এই ডি কক একাই বলতে গেলে যা করার করে দিয়েছেন। খেলেছেন ১৪০ বলে ১৭৪ রানের ইনিংস। ১৫ বাউন্ডারি আর ৭ ছক্কায় সাজানো তার বিধ্বংসী ইনিংসটি শেষ পর্যন্ত থামিয়েছেন হাসান মাহমুদ। ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট বাউন্ডারিতে ক্যাচ ধরেছেন নাসুম আহমেদ। এরপর তাণ্ডব শুরু ক্লাসেনের। চারের চেয়ে ছক্কা মারার দিকেই বেশি মনোযোগ ছিল এই ব্যাটারের। এমন বিধ্বংসী ব্যাটিংই করেছেন, তার সেঞ্চুরির সুযোগও তৈরি হয়েছিল। ইনিংসের ৪ বল বাকি থাকতে হাসান মাহমুদের বলে মাহমুদ উল্লাহকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ক্লাসেন। ৪৯ বলে ৯০ রানের ইনিংসে ২টি চারের সঙ্গে ৮টি ছক্কা ছিল। শেষদিকে ১৫ বলে ১ চার আর ৪ ছক্কায় অপরাজিত ৩৪ আসে ডেভিড মিলারের ব্যাট থেকে। মাহমুদ ২ উইকেট পেলেও ৬ ওভারে খরচ করেন ৬৭ রান। একটি করে উইকেট নেন মেহেদী হাসান মিরাজ, শরিফুল ইসলাম আর সাকিব আল হাসান। শেষ ১০ ওভারে ১৪৪ রান তুলেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। সবমিলিয়ে ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ৩৮২ রানে থেমেছে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস।
পথরেখা/আসো