অনিন্দিতা আরিফ : গ্যালারিতে লাখো দর্শকের নীল–সমুদ্র, ক্ষণে ক্ষণে সেই সমুদ্রের গর্জন, আর প্রতিটি চার–ছয়ে আতশবাজি ও আলোর ফোয়ারা—উৎসব আর উচ্ছ্বাসের মহামঞ্চ প্রস্তুত ছিল ভারতের জন্য। ফাইনালের পথে একের পর এক প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে আসা রোহিত শর্মাদের হাতে ট্রফি দেখতে মাঠে উপস্থিত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।
কিন্তু বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে কঠিন লড়াই আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় সব প্রতিকূলতা উড়িয়ে দেওয়ার চিরন্তন সেই অস্ট্রেলিয়া আহমেদাবাদে ভারতকে ৬ উইকেটে হারিয়ে জিতেছে গৌরবের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ। এ যেনো নীলরাজত্যের হলুদের আলোর ঝিলিক। এর আগে ১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। এবার ভারতের মাটিতে রোহিত-বিরাট-শামি-বুমরাদের হারিয়ে শিরোপা জয়ে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে গেল ডাবল হ্যাটট্রিক। ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছিলো ভারত। ভারত ফাইনালে উঠলেও তৃতীয়বারের মত শিরোপা জিততে ব্যর্থ হলো; হলো তাদের হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের স্বপ্ন পূরণ।
বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুলের জোড়া হাফ-সেঞ্চুরিতে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৪০ রান করে স্বাগতিক ভারত। রাহুল সর্বোচ্চ ৬৬ ও কোহলি ৫৪ রান করেন। অস্ট্রেলিয়ার পেসার মিচেল স্টার্ক ৫৫ রানে ৩ উইকেট নেন। জবাবে হেডের সেঞ্চুরিতে ৪২ বল বাকী রেখেই চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় পড়ে। আসরে প্রথম দুই ম্যাচে হেরে যাত্রা শুরু করা অস্ট্রেলিয়া কতটা পেশাদার দল আবারো প্রমাণিত হয়েছে।
আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠান অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। শুভমান গিলকে নিয়ে ঝড়ো গতিতে শুরু করেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ৪ ওভারে দলকে ৩০ রান এনে দেন রোহিত-গিল। ভালো শুরুর পর পঞ্চম ওভারে দলীয় ৩০ রানে বিচ্ছিন্ন হয় উদ্বোধনী জুটি । পেসার মিচেল স্টার্কের করা পঞ্চম ওভারের দ্বিতীয় বলে পুল শট খেলতে গিয়ে মিড অনে এডাম জাম্পাকে ক্যাচ দেন জুটিতে ৭ বল খেলে মাত্র ৪ রান করা গিল। তিন নম্বরে নামা বিরাট কোহলি স্টার্কের করা সপ্তম ওভারের প্রথম তিন বলেই বাউন্ডারি মারেন। ১০ম ওভারে স্পিনার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের প্রথম দুই বলে ১০ রান তুলে নেন রোহিত। তৃতীয় বলে উইকেট ছেড়ে ছক্কা মারতে গিয়ে কভার পয়েন্টে ট্রাভিস হেডের দারুণ ক্যাচে বিদায় ঘটে ৪৭ রান করা রোহিতের। ৩১ বল মোকাবেলায় ৪টি চার ও ৩টি ছক্কা মারেন ভারতীয় অধিনায়ক। দ্বিতীয় উইকেটে রোহিত-কোহলি ৩২ বলে ৪৬ রান যোগ করেন। অধিনায়কের বিদায়ে উইকেটে এসে বাউন্ডারিতে রানের খাতা খুলেন গত দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করা শ্রেয়াস আইয়ার। কিন্তু আইয়ারকে এবার ৪ রানে থামিয়ে দেন অসি দলপতি কামিন্স। ৫ বল ও ৫ রানের ব্যবধানে রোহিত ও আইয়ারকে হারিয়ে চাপে পড়ে ভারত। ১১তম ওভারে দলীয় ৮১ রানে ভারতের তিন ব্যাটার প্যাভিলিয়নে ফেরার পর জুটি বাঁধেন কোহলি ও লোকেশ রাহুল। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং ও পরিকল্পনামাফিক ফিল্ডিংয়ে স্ট্রাইক রোটেট করেই খেলতে হয়েছে কোহলি ও রাহুলকে। এতে ৯৭ বল চার-ছক্কার দেখা পায়নি ভারত। এ অবস্থাতেই ২৬তম ওভারে ওয়ানডেতে ৭২তম হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান ৫৬ বল খেলা কোহলি। বিশ^কাপের নক আউটের দুই ম্যাচে ৫০এর বেশি রান করার তালিকায় সপ্তম ব্যাটার হিসেবে নাম তুলেন কোহলি। বিশ^কাপ ইতিহাসে প্রথম ব্যাটার হিসেবে দ্বিতীয়বারের মত টানা পাঁচ ম্যাচে ৫০এর বেশি রানের ইনিংস খেললেন তিনি। এর আগে ২০১৯ আসরে এ রকের্ড গড়েছিলেন তিনি।
হাফ-সেঞ্চুরির পর ইনিংস বড় করতে পারেননি কোহলি। কামিন্সের বলে ইনসাইড এজ হয়ে বোল্ড আউট হওয়ার আগে ৪টি চারে ৬৩ বল খেলে ৫৪ রানের লড়াকু ইনিংস খেলেন ইনফর্ম কোহলি। চতুর্থ উইকেটে ১০৯ বলে ৬৭ রান যোগ করেন কোহলি-রাহুল। বিশ্কাবপে এবারের আসরে ১১ ইনিংসে ৭৬৫ রান করেছেন কোহলি। যা এক আসরে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। কোহলির বিদায়ে উইকেটে আসেন রবীন্দ্র জাদেজা। আবারও জুটি গড়ার চেষ্টা করেন রাহুল ও জাদেজা। ৩৫তম ওভারে ওয়ানডেতে ১৭তম অর্ধশতক পূর্ণ করতে ৮৬ বল খেলেছেন রাহুল। রাহুলের অর্ধশতকের পর জাদেজার বিদায় নিশ্চিত করেন পেসার জশ হ্যাজেলউড। ২২ বলে ৯ রান করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন জাদেজা। রাহুল-জাদেজা জুটি ৪৪ বলে ৩০ রান যোগ করেন। সূর্যকুমার যাদবকে নিয়ে ৪১তম ওভারে ভারতের রান ২শতে নেন রাহুল। অস্ট্রেলিয়ার টাইট বোলিংয়ের বিপরীতে ১১ থেকে ৪০ ওভারের মধ্যে মাত্র দু’টি বাউন্ডারি মারতে সক্ষম হয় ভারতীয় ব্যাটাররা। এর মাধ্যমে এবারের বিশ^কাপে মিডল ওভারে সবচেয়ে কম বাউন্ডারি মারা দল হিসেবে নাম লেখালো ভারত। এছাড়া প্রথমবারের মত এই বিশ^কাপে মাঝের ওভারে ছক্কা মারতে ব্যর্থ হলো ভারত। দলের ২শতে পৌঁছানোর ওভারেই বিদায় নেন রাহুল। স্টার্কের অফ স্টাম্পের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তিনি। মাত্র ১টি চারে ১০৭ বল খেলে ৬৬ রানের ধৈর্য্যশীল ইনিংস খেলেন রাহুল। তার স্ট্রাইক রেট ছিলো ৬১ দশমিক ৬৮। এবারের বিশ^কাপে ৫০এর বেশি রানের ইনিংস খেলা ব্যাটারদের মধ্যে যা সর্বনি¤œ স্ট্রাইক রেট। সূর্য-রাহুল ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ২৫ রান যোগ করেন। দলীয় ২০৩ রানে ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে রাহুল ফেরার পর সূর্য ও টেল এন্ডারদের নিয়ে ৫০ ওভার খেলে সব উইকেট হারিয়ে ২৪০ রানের সংগ্রহ পায় ভারত। বল হাতে অস্ট্রেলিয়া স্টার্ক ৫৫ রানে ৩টি, হ্যাজেলউড ৬০ রানে ও কামিন্স ৩৪ রানে ২টি করে উইকেট নেন। ১টি করে উইকেট নেন ম্যাক্সওয়েল ও জাম্পা। এই বিশ^কাপে মোট ২৩ উইকেট শিকার করলেন জাম্পা। এর মাধ্যমে এক আসরে স্পিনার হিসেবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারে শ্রীলংকার মুত্তিয়া মুরলিধরনের রেকর্ড স্পর্শ করলেন জাম্পা। ২০০৭ সালের বিশ^কাপে ২৩ উইকেট নিয়েছিলেন মুরলিধরন।
২৪১ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ সামির বলে স্লিপে কোহলিকে ক্যাচ দেন ৭ রান করা ডেভিড ওয়ার্নার। এর মাধ্যমে এবারের বিশ^কাপে সর্বোচ্চ ২৪ উইকেটের মালিক হন সামি।
তিন নম্বরে ব্যাট হাতে নেমে দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করেন মিচেল মার্শ। ১টি করে চার-ছক্কাও হাঁকান তিনি। পঞ্চম ওভারে মার্শকে (১৫) রানে বিদায় দেন ভারতের আরেক পেসার জসপ্রিত বুমরাহ। মার্শের বিদায়ে উইকেটে এসে বাউন্ডারি দিয়ে রানের খাতা খোলেন স্টিভেন স্মিথ। কিন্তু ঐ ৪ রানেই স্মিথকে লেগ বিফোর আউট করেন বুমরাহ। স্মিথকে তুলে নিয়ে এবারের বিশ^কাপে ৯৮তম শিকার পূর্ণ করেন ভারতীয় বোলাররা। বিশ^কাপ ইতিহাসে এক আসরে যা সর্বোচ্চ শিকার কোন দলের। সপ্তম ওভারে দলীয় ৪৭ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। এ অবস্থায় বড় জুটির প্রত্যাশা পূরণ করেছেন আরেক ওপেনার ট্রাভিস হেড ও মার্নাস লাবুশেন। ঠান্ডা মাথায় স্ট্রাইক রোটেট করে রানের চাকা সচল রেখে ২০তম ওভারেই দলীয় রান ১শ তে পৌঁছে দেন হেপ-লাবুশেন। ২২তম ওভারে ওয়ানডেতে ১৭তম হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৫৮ বল খেলা হেড। ২৭তম ওভারে জুটিতে শতরান পূর্ণ করেন হেড ও লাবুশেন। ৩৪তম ওভারের পঞ্চম বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে পঞ্চম সেঞ্চুরির দেখা পান হেড। তিন অংকে পৌঁছতে ৯৫ বল খেলে ১৪টি চার ও ১টি ছক্কা মারেন এই বাঁ-হাতি ব্যাটার। ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে বিশ^কাপের ফাইনালে সেঞ্চুরির নজির গড়েন হেড। এর আগে ফাইনালে সেঞ্চুরি করেছিলেন- ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড-ভিভ রিচার্ডস, অস্ট্রেলিয়ার এডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিং ও শ্রীলংকার মাহেলা জয়াবর্ধনে। হেডের সেঞ্চুরিতে ৩৭তম ওভারে ২শ রানে পৌঁছে জয়ের পথ সহজ করে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। লাবুশেনকে নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার জয় নিশ্চিত করার পথেই ছিলেন হেড। কিন্তু দলের জয় থেকে মাত্র ২ রান দূরে থাকতে ৪৩তম ওভারে মোহাম্মদ সিরাজের বলে আউট হন হেড। এরপর বাকী ২ রান নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার শিরোপা নিশ্চিত করেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। চতুর্থ উইকেটে লাবুশেনের সাথে ২১৫ বলে ১৯২ রানের জুটি গড়েন হেড। ১৫টি চার ও ৪টি ছক্কায় ১২০ বলে ১৩৭ রান করেন ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হওয়া হেড। লাবুশেন ৫৮ ও ম্যাক্সওয়েল ২ রানে অপরাজিত থাকেন। ভারতের বুমরাহ ২টি উইকেট নেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত : ২৪০/১০, ৫০ ওভার (রাহুল ৬৬, কোহলি ৫৪, স্টার্ক ৩/৫৫)।
অস্ট্রেলিয়া : ২৪১/৪, ৪৩ ওভার (হেড ১৩৭, লাবুশেন ৫৮*, বুমরাহ ২/৪৩)।
ফল : অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে জয়ী।
পথরেখা/আসো